শোভন রেজা : সজীব ওয়াজেদ জয় ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছেন তার ভেরিফাইড পেইজে বাংলাদেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টের পক্ষে উনার সমর্থন জানিয়ে। তিনি ফ্রান্সের বিরোধী দলীয় নেত্রী ম্যারি লা-পেনের শাস্তির উদাহরণ টেনে বলেছেন পশ্চিমা দেশগুলোও ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট ব্যবহার করে, যারা বাংলাদেশের বাকস্বাধীনতা অভাব নিয়ে “পশ্চিমা প্রভুদের” কাছে বিচার দেয়, তাদের এটা দেখে নেয়া উচিত।
এটা নিয়ে বাংলাদেশী সংবাদ মাধ্যমে খুব ভালো, প্রাণবন্ত আলোচনা হতে পারতো। কিন্তু সেটা হয় নি, সংবাদ মাধ্যমগুলো জয়ের পোস্টটাকেই খবর হিসাবে প্রকাশ করেছেন।
জয় বলেছেন “পশ্চিমা প্রভুদের” একই ধরণের আইন আছে। তিনি বলেছেন এটা প্রমাণ করে “বাকস্বাধীনতার সীমা আছে”।
প্রথম কথা হচ্ছে ফরাসি আদালত আর ইউরোপীয় পার্লামেন্ট লা পেনের টুইটকে সরকারবিরোধী বা রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা হিসাবে শাস্তিযোগ্য ভাবেনি। এই টুইটকে তারা hate speech হিসাবে গণ্য করেছে। Hate speech বাকস্বাধীনতা দিয়ে protected কিছু না। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বলেছে- “violent messages that incite terrorism or pornography or seriously harm human dignity” যেটা শিশুদের নজরে আসলে তাদের ক্ষতির কারণ হতে পারে। কই পেলাম? জয় যে লিংক শেয়ার করেছেন সেখানেই ছিল লেখাটা।
ফ্রান্সের সামাজিক অবস্থা খুবই নড়বড়ে। শুধু ফ্রান্সে না, ইউরোপ জুড়েই জেনোফোবিয়া বা বিদেশিভীতি চরমে উঠে আছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। এই প্রেক্ষিতে একটা রাজনৈতিক দলের নেতার এমন বার্তা প্রচার করাকে অনেকেই রুচিসম্মত ভাবছেন না, অনেকে ভাবছেন ভীতিকর। আলোচ্য টুইটে (আইএসের করা হত্যাকাণ্ডের ছবি) ইসলামোফোবিক কিছু আছে কি না, ইসলামোফোবিয়া আসলেও গ্রহণযোগ্য কোনো অপরাধ কী না, সেগুলো ভিন্ন আলোচনার বিষয়। এই আলোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই। সমাজবিজ্ঞানীরা এ নিয়ে উৎকৃষ্ট আলোচনা করতে পারবেন। এবং করা উচিত।
কিন্তু, more to the point- বাকস্বাধীনতা একজন মানুষের জন্মসিদ্ধ অধিকার, নাগরিক অধিকার। Hate speech না। জয় hate speech-কে বাকস্বাধীনতা বলে দুইটা জিনিসকেই disservice করেছেন। এতে করে confusion সৃষ্টি হবে।
দেখতে চান? দেখাচ্ছি। ফেইসবুকের নিউজপোর্টলের কমেন্ট সেকশন ঘুরে দেখুন, নারীবিদ্বেষী, হিন্দুবিদ্বেষী মন্তব্যে ভরা একেকটা কমেন্ট সেকশন। প্রধানমন্ত্রীকে লিঙ্গভিত্তিক গালি, এমনকি জয়কেও বিভিন্ন ধরণের গালিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে মানুষ। সেগুলো বাকস্বাধীনতা না, সেগুলো hate speech। এদের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়?
একই সময়ে কার্টুনিস্টরা, কলামিস্টরা, ব্লগাররা, ফেসবুকের একটিভিস্টরা যখন সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করেন, তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারা তাদের বাকস্বাধীনতার চর্চা করছেন। তারা কাউকে গালি দিচ্ছেন না। কারো শারীরিক অসুস্থতাকে কটাক্ষ করছেন না, কারো লিঙ্গকে, কারো ধর্মকে ভিত্তি করে কাউকে ব্যক্তিগত গালি দিচ্ছেন না। কিন্তু এরাই জনশত্রু বলে বিবেচিত হন। এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, এদের গ্রেফতার করে রাখা হয়।
আমরা কী ধরে নিতে পারি যে সরকারের কাছে গালি গ্রহণযোগ্য, কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণযোগ্য না? এমন তো হতেই পারে না!
রাষ্ট্রের নাগরিক প্রশ্ন করবেই। প্রশ্ন করা, সমালোচনা করা তার সংবিধানসিদ্ধ অধিকার। সমালোচনা করা অপরাধ না। রাষ্ট্র একটা অত্যন্ত ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান। তার অধীনে পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা, সেনা আছে। সাধারণ নাগরিক যখন রাষ্ট্রের সমালোচনা করে তখন সে একা, ক্ষমতাহীন। এমন অবস্থায় সুরক্ষা কার দরকার? রাষ্ট্রের, না নাগরিকের?
ভারতীয় সাংবাদিক রবিশ কুমার বলেছিলেন
রাষ্ট্রকে যে প্রশ্ন করবে তাকে পুরষ্কার দেয়া উচিত। কারণ রাষ্ট্র একেকটা সিদ্ধান্ত একা নেয় না, তার সিদ্ধান্ত নিতে বিশেষজ্ঞদের লাগে, আমলা লাগে, গবেষণা লাগে। কিন্তু একজন সাধারণ নাগরিক যখন সে সিদ্ধান্তের ফাঁকফোকর দেখে প্রশ্ন করে তখন রাষ্ট্রের উচিত তার বুদ্ধিমত্তার জন্য তাকে পুরষ্কার দেয়া।
রাষ্ট্রের জনগণের কাছ থেকে নিরাপত্তা প্রয়োজন নাই, জনগণকে বরং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা দেয়া উচিত।
“পশ্চিমা প্রভু” কারা আসলে? আমরা যাদের মত হতে চাই? আমরা যখন বলি First World Countries, World Leaders তখন আমরা কী বুঝাই আসলে? ওরা আমাদের চেয়ে সকল দিক দিয়েই উন্নত, এটাই তো বুঝাই? তাদের মানদণ্ড ধরে আমরা সামনে আগাই। তাই তো?
আমাদের শহরকে আমরা তাদের শহরের সাথে তুলনা করি কেন? কারণ তাদের শহরের মত আমাদের শহর বানাতে চাই, তাই তো? নির্বাচনের সময় কেন নির্বাচন নিয়ে ওদের মতামতকে আমরা এত গুরুত্ব দেই?
কিন্তু তাই বলে কি আমরা তাদের সব কিছু মেনে নিই? আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বাদ দিয়ে আমরা ওদের সংস্কৃতি মেনে নিবো? ওরা কি ভুল করতে পারে না? আমরা কী ওদের fault এর প্রতিও loyal থাকবো?
আমার (সার্কাজম) “পশ্চিমা প্রভুদের” কাউকেই আমি দেখি নাই জনগণের মতামত থেকে সরকারকে বাঁচানোর জন্য আইন বানাতে। জনগণের মধ্যে বাড়ন্ত জেনোফোবিয়া থেকে অন্য জনগণকে বাঁচাতে, আর সেখানে যেন কোনো রাজনৈতিক নেতা/নেত্রী উস্কানী না দিতে পারে, সে জন্যে Hate Speech-কে দমন করা কারো বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না।
আপনার মতামত জানানঃ