সয়াবিন ও সরিষা তেল এদেশে একচেটিয়া বাজার ধরে রেখেছে। তবে সরিষা তেলটা ব্যবহারের কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্র তৈরী হওয়াতে এর ব্যবহার সয়াবিনের চেয়ে অনেকটাই কম। সয়াবিন তেলটাই মূলত রান্নাবান্নার কাজে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বলা চলে, সয়াবিন তেল দীর্ঘদিন ধরেই ভোজ্যতেলের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে। তবে বছর কয়েক আগে ধানের কুঁড়া থেকে তেল উৎপন্ন শুরু হলে সয়াবিন কিছুটা নত হয়ে আসে। স্বাস্থ্যসম্মত হওয়ায় ধানের কুঁড়া থেকে তৈরি ভোজ্যতেলের (রাইস ব্রান অয়েল) চাহিদা দেশে ক্রমেই বাড়ছে। সয়াবিন তেলের পাশাপাশি মানুষ এখন এই তেলের দিকে ঝুঁকছেন। সে কারণেই কুঁড়ার তেল উৎপাদনকারীরা তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াচ্ছেন। নতুন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। সম্প্রতি জানা গেলো ভোজ্য তেলের তালিকায় অচিরেই যোগ হচ্ছে ভুট্টা থেকে উৎপন্ন তেল। বাংলাদেশে ভুট্টা থেকে তেল উৎপাদনের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, দেশে শিল্প-কারখানা স্থাপন করে বাণিজ্যিকভাবে ভুট্টার তেল উৎপাদন করতে পারলে বিদেশ থেকে তেল আমদানি হ্রাস, অন্যদিকে তেলের দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসলে দেশের কৃষক লাভবান হবে। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে নাসির স্টার্চ, অয়েল অ্যান্ড অ্যানিমেল ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ পরিদর্শন শেষে গত শনিবার(০৬ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় তিনি এ কথা বলেন।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. এছরাইল হোসেন, নাসির গ্লাসওয়্যার অ্যান্ড টিউব ইন্ডাস্ট্রিজের মহাব্যবস্থাপক ফজলুল রহমান, উপ-মহাব্যবস্থাপক কাজিমুল বাশার প্রমুখ। মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল রোববার(০৭ ফেব্রু) এ তথ্য জানানো হয়।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়ক হবে। কৃষিমন্ত্রী এ সময় উদ্যোক্তাদের ভুট্টার তেল উৎপাদনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস প্রদান করেন।
গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. এছরাইল হোসেন বলেন, দেশে বর্তমানে উৎপাদিত ৫৪ লাখ টন ভুট্টা থেকে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টন ভুট্টা তেল প্রতি বছর আহরণ করা সম্ভব, যার বাজারমূল্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। ভুট্টা তেল তৈরির পাশাপাশি ভুট্টা থেকে কর্ন ফ্লেক্স কর্ন চিপস তৈরি করাও সম্ভব। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু ভুট্টা চাষের অনুকূল। কৃষকদের কাছেও ভুট্টা চাষ জনপ্রিয়তা লাভ করছে। বর্তমানে দেশে ভুট্টা চাষের মোট আবাদি জমি সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টরেরও অধিক। আর উৎপাদন ৫৪ লাখ টন।
উন্নত দেশে ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহার থাকলেও দেশে শুধু প্রাণী, পোলট্রি ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত ভুট্টার অধিকাংশই বা প্রায় ৯৫ শতাংশ প্রাণী, হাঁস-মুরগির ফিড ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হয়। তবে ইদানীং খই ভুট্টা, মিষ্টি ভুট্টা (৫ শতাংশ) হিসেবেও মানুষের খাদ্য হিসেবে বেশ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।
উন্নত বিশ্বে ভুট্টা থেকে স্টার্চ, ইথানল, জৈব জ্বালানি, তেল উৎপাদনসহ রয়েছে আরো বহুমুখী ব্যবহার। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৫২টি দেশে ভুট্টা থেকে উত্কৃষ্ট মানের ভোজ্যতেল উৎপাদিত ও ব্যবহৃত হয়।
গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ভুট্টা তেল স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। এতে কোনো আমিষ বা শর্করা নেই, শতকরা ১০০ ভাগই চর্বি বিদ্যমান যার পুষ্টিমান অন্যান্য তেলের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। ভুট্টা তেলে বিদ্যমান সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেলের সমপরিমাণ। ভুট্টা তেলে ভিটামিন-ই (টোকোফেরল)-এর পরিমাণ সূর্যমুখী তেলের চেয়ে বেশি। ভুট্টা তেলে ভিটামিন-কে (১ দশমিক ৯ মাইক্রো গ্রাম) রয়েছে যেখানে সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেলে তা অনুপস্থিত। সালাদ, বিস্কুট, চানাচুর, কেক, পাউরুটি, মাখন তৈরিতে ভুট্টা তেল ব্যবহূত হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভোজ্যতেলের তালিকায় নতুন তেল এলে বাজারে তেলের সহজলভ্যতা অনেকটাই বেড়ে যাবে। ফলে দুই দিন পর পর ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি অনেকটা লাঘবে চলে আসবে বলে মনে করেন তারা। তবে ভুট্টা থেকে তেল উৎপন্ন কতটা স্বাস্থ্যসম্মত হবে, হতে হলে কী কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দিকটা কেমন ক্ষতিকর হতে পারে, এবিষয়গুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই শেষে বাজারে আনার আহ্বান জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৪৭
আপনার মতামত জানানঃ