সড়কে এত এত দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটে যে রেল দুর্ঘটনা এতে অনেকটাই আড়ালে পড়ে যায়। তবে এতে রেল দুর্ঘটনাকে ছোট করেও দেখার সুযোগ নেই। রেল দুর্ঘটনা বরং সড়ক দুর্ঘটনার চেয়েও অনেক ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনে। গণহারে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ দাঁড়িয়েছে এই রেল দুর্ঘটনা।
দেশের রেল দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঘটে থাকে সিলেট অঞ্চলে। সিলেটের রেললাইন লক্কড়ঝক্কড় হওয়ায় ঘন ঘন দুর্ঘটনা বাড়ছে। কোনোভাবেই দুর্ঘটনা থেকে রেহাই মিলছে না। গত ৬ মাসে ৭টি ট্রেন দুঘর্টনার শিকার হয়েছে। প্রতিবার দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পর শুরু হয় তোড়জোড়। চলে ঘটনার ময়নাতদন্ত। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি, এরপর যেই সেই। সরকারের পক্ষ হতে বলা হয় সিলেটে নতুন লাইন করতে প্রকল্প নেয়ার প্রক্রিয়াধীন। আশার বানীতেই দিন যাচ্ছে সিলেটবাসীর। সবার প্রশ্ন, আর কত দুঘর্টনা ঘটলে সরকারের টনক নড়বে?
যদিও নতুন ট্রেনের বগি সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু ট্রেন দুর্ঘটনা কমছে না। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় ফেঞ্জুগঞ্জ মাইজগাঁও নামক স্থানে তেলবাহী ট্রেনের ১০টি বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় সিলেট অঞ্চলের ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এসময় তেলবাহী ওই ট্রেনের ১০টি বগিই লাইনচ্যুত হওয়ার সাথে প্রায় ৮০০ মিটার রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসময় ট্রেনে থাকা দুই লাখ ৭৪ হাজার লিটার জ্বালানি তেল নষ্ট হয়েছে। সারা দেশের সাথে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সিলেট অঞ্চল। এর আগে একই স্থানে আরো তিনবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ট্রেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলেট-ঢাকা রেলপথে যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তার অধিকাংশই সিলেট-আখাউড়া সেকশনে। জরাজীর্ণ রেললাইন, পুরনো ইঞ্জিন ও বগি, উঁচুনিচু পাহাড়ি এলাকা দিয়ে যাওয়া রেলপথ, রেলকর্মীদের দায়িত্বে অবহেলাসহ বিভিন্ন কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটছে।
ঢাকা-সিলেট রেলপথের আখাউড়া-সিলেট অংশে প্রায়ই রেল দূর্ঘটনা ঘটছে। কখনো যাত্রীবাহী ট্রেন আবার কখনো তেলবাহী ট্রেন দুর্ঘটনায় কবলিত হচ্ছে। আর এ জন্য রেল লাইনের দুরাবস্থাকেই দায়ি করছে রেল কতৃপক্ষ। তাদের মতে, পুরনো রেল লাইন, রাতে পর্যাপ্ত আলোর অভাব, ঘন কুয়াশা আবার কখনো চালকর দ্বায়িত্বহীনতার কারণেই এসব দূর্ঘটনা ঘটছে।
ঢাকা-সিলেট রেলপথের আখাউড়া-সিলেট অংশে প্রায় দুই কিলোমিটার রেললাইন জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ফলে এই রেলপথটিতে হরহামেশাই লাইনচ্যুত হচ্ছে ট্রেন। সিলেট-আখাউড়া রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৭৯ কিলোমিটার। জরাজীর্ণ হয়ে পড়া এ সেকশনে রয়েছে ১৩টি মহাঝুঁকিপূর্ণ সেতু। রেলওয়ের ভাষায় যা ‘ডেড স্টপ’। এছাড়া ট্রেন লাইনও ত্রুটিপূর্ণ। এসবের সঙ্গে রয়েছে ট্রেনের পুরনো ইঞ্জিন আর বগি। এসব মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সিলেট-আখাউড়া রেলপথে ট্রেন ভ্রমণ।
করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের ২৪ মার্চ থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মাস সিলেট-আখাউড়া রুটে রেল চলাচল বন্ধ ছিল। ১৬ আগস্ট থেকে সীমিত আকারে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ মাসে এ রুটে অন্তত নয়টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় প্রতি মাসেই ঢাকা-সিলেট রেলপথের আখাউড়া-সিলেট অংশে এক বা একাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে। এর বেশির ভাগই লাইনচ্যুতির ঘটনা। এর মধ্যে ২০১৯ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু লাইনচ্যুতির ঘটনাই ঘটেছে নয়টি। এছাড়া মুখোমুখি সংঘর্ষ ও সেতু ভেঙে রেলের বগি পানিতে পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে।
২০১৯ সালের জুনে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচালে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান চার যাত্রী ও আহত হন শতাধিক। প্রতিবছর সিলেট-আখাউড়া রেলপথে ১৫-২০টি ছোট ছোট দুর্ঘটনা ঘটছেই। ২০২০ সালে দীর্ঘদিন করোনার কারণে রেল চলাচল বন্ধ থাকলেও সে বছরের আগস্ট থেকে চালু হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তেলবাহী ট্রেনসহ ৯টি ট্রেন দুর্ঘটনাকবলিত হয়। গত ৬ ডিসেম্বর দুপুরে মাধবপুরের শাহাজীবাজার রেলস্টেশনের পাশে তেলবাহী ট্রেনের পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এ কারণে ১৩ ঘণ্টা সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকে। ১১ নভেম্বর সিলেট ও মৌলভীবাজারের মধ্যবর্তী ভাটেরায় মালবাহী ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এতে বন্ধ হয়ে যায় সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ। ৭ নভেম্বর সাতটি বগি নিয়ে শ্রীমঙ্গলে তেলবাহী একটি ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়। এতে ২৩ ঘণ্টা বন্ধ থাকে রেল যোগাযোগ। একই স্থানে ২০১৮ সালে ১১টি বগি নিয়ে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। গত বছরের ৩০ অক্টোবর সিলেট রেলস্টেশনে ডকইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়িকা এক্সপ্রেসের সামনের দিকে ধাক্কা দেয় জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস। ১৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও এলাকায় তেলবাহী ওয়াগনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ২৩ আগস্ট যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয় কুলাউড়া এলাকায়। একই স্টেশনে গত ২৪ জানুয়ারীর ট্রেনের বগিতে আগুন ধরে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে এ রুটে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে গত বছরের ২৩ জুন। এদিন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল এলাকায় উপবন এক্সপ্রেসের পাঁচটি বগি সেতু ভেঙে ছড়ায় পড়ে যায়। এতে চারজন নিহত ও শতাধিক যাত্রী আহত হন। ২১ ঘণ্টা পর রেল চলাচল স্বাভাবিক হয়।
দেশের অন্যান্য রেলপথের চেয়ে ঢাকা-সিলেট রেলপথের আখাউড়া-সিলেট অংশে দুর্ঘটনার হার তুলনামূলক বেশি। এর কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এই সেকশনটির অনেক স্থানে একটা ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালানো সম্ভব হয় না। প্রয়োজন হলে ট্রেনের পেছনে আরো একটি ইঞ্জিন জুড়ে দিয়ে ট্রেন টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এটা করতে গিয়ে অনেক সময় ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। তখন লাইনচ্যুতিসহ ট্রেন দুর্ঘটনার শঙ্কা বেড়ে যায়।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, সিলেট-কুলাউড়া-আখাউড়া সেকশনে আগে ট্রেন চলত ৭০-৮০ কিলোমিটার গতিতে। এখন সে গতি অর্ধেকে অর্থাৎ ৪০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের তথ্যমতে, আখাউড়া-সিলেট রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনি এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রতিদিন ১২-১৫ হাজার যাত্রী সিলেট-ঢাকা এবং সিলেট-চট্টগ্রাম যাতায়াত করেন।
সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনের মোগলাবাজার থেকে মাইজগাঁও পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ জায়গায় স্লিপারের নাট-বল্টু খুলে গেছে। আবার কোথাও নাট-বল্টু ঢিলে থাকায় রেললাইন নড়বড়ে হয়ে আছে। রেলের দুই স্লিপারের মাঝখানে নেই পর্যাপ্ত পাথর।
এ সেকশনের সেতুগুলোর অবস্থা আরো নাজুক। রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, নির্মাণের ৫০-৫৫ বছর পরই সেতুর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। অথচ এ রুটের ৯০ শতাংশ সেতুর বয়সই ৭০ বছর পেরিয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ রকম ১৩টি স্পটকে ‘ডেড স্টপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
রেলওয়ের বিভাগীয় আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) সাদিকুর রহমান বলেন, সিলেট থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রেলপথ জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। এছাড়া পাহাড় ও টিলাভূমির ভেতর দিয়ে অনেকটা পথ ট্রেন চলাচল করে। ফলে এখানে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।
পুরনো রেলপথটি সংস্কার করে বিদ্যমান মিটার গেজ রেললাইনকে ডুয়েল গেজে রূপান্তর করার একটি প্রকল্প চার বছর আগে গ্রহণ করে রেল মন্ত্রণালয়। তবে এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। গত বছর একটি দুর্ঘটনার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ড. এ কে আব্দুল মোমেন সিলেট-আখাউড়া রেলপথ ডুয়েল গেজে রূপান্তরের কাজ দ্রুত সম্পন্নের তাগিদ দিয়ে রেল মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার প্রদান করেন। এর পরও কাজ শুরু হয়নি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, রেলপথ সংস্কার এবং যথাযথ মেরামত রাখা যাদের দায়িত্ব, তারা যদি দায়িত্বে কোনো গাফিলতি করেন, সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া, এমনকি কারও দায়িত্বে অবহেলার জন্য লাইনচ্যুত কিংবা দুর্ঘটনা ঘটে, তাদের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষ জানালেও বাস্তবের চিত্র উল্টো। যেন কারও কোনো মাথা ব্যথা নেই।
তারা জানান, পুরো রেলে হাজার হাজার স্লিপার জরাজীর্ণ রয়েছে। নাটবোল্টু, হুক-ক্লিপ, ফিশপ্লেট খোলা অবস্থায় রয়েছে পদে পদে। এসব মেরামত কিংবা পূরণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাথাব্যথা নেই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তথা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ শুধু প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। মাঠ পর্যায়ে যে কাজের স্বল্পতা রয়েছে সেদিকে খেয়ালই নেই।
তার বলেন, নিয়মানুসারে একটি স্পিপার কিংবা নাটবোল্টু, ক্লিপ-হুক-ফিশপ্লেট খোলা থাকলে প্রয়োজনে ট্রেন দাঁড় করিয়ে হলেও তা সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই নাটবোল্টু, হুক-ক্লিপ-ফিশপ্লেট খোলা থাকতে পারে না। ওয়েম্যানরা প্রতিদিন লাইন পরিদর্শন করবে, এমন ত্রুটি দেখা মাত্রই তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাবে এবং সেই সমস্যা সমাধান করবে। রেলে এ নিয়মটাই নেই!
সাম্প্রতিক সময়ে রেল দুর্ঘটনা যে আতঙ্ক তৈরী হয়েছে, এর রেশ কেটে গেলে আবার যেই সেই অবস্থাতে চলে যাবে কর্তৃপক্ষ। তারা মনে করেন, রেল দুর্ঘটনা রোধে সরকারকে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০২
আপনার মতামত জানানঃ