রাজবাড়ী থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ ও পুরোনো লাইন সংস্কারে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করার সময় বলা হয়েছিল, এই রেললাইন দিয়ে দিনে ১৪টি ট্রেন চলাচল করবে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন এই রেলপথ উদ্বোধন করেন। এখন এই পথে ট্রেন চলছে মাত্র দুটি।
রাজবাড়ী–গোপালগঞ্জের মতো ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্মিত আটটি রেললাইন সক্ষমতার তুলনায় অনেক কম ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাকি সাতটি রেললাইন হলো পাবনা–ঢালারচর, কুমিল্লার লাকসাম–চিনকি আস্তানা (চট্টগ্রামের কাছে), চট্টগ্রামের দোহাজারী–কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া–কুমিল্লার লাকসাম, খুলনা–মোংলা, আখাউড়া–আগরতলা (ভারত) এবং পদ্মা রেলসংযোগ (ঢাকা থেকে যশোর)। এগুলো নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৭১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। কিন্তু সুফল কম। ফলে রেললাইনগুলোকে বলা হচ্ছে ‘সাদা হাতি’।
‘সাদা হাতি’ বাগ্ধারাটি দিয়ে বোঝানো হয়, যার পেছনে প্রচুর ব্যয় হয়, কিন্তু সুফল পাওয়া যায় না। থাইল্যান্ডে রাজারা সাদা হাতি পুষতেন। প্রাণীটিকে ধরা হতো পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে। সাদা হাতি দিয়ে কোনো কাজ করানো নিষিদ্ধ ছিল। রাজারা কারও ওপর নাখোশ হলে তাঁকে বিপাকে ফেলতে সাদা হাতি উপহার দিতেন। উপহার পাওয়া ব্যক্তি সাদা হাতি পুষতে গিয়ে আর্থিক দুর্দশার মধ্যে পড়তেন।
সূত্র বলছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের ওই সব প্রকল্পের কোনোটি নেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়, কোনোটি অর্থায়নকারী কোনো দেশের পরামর্শে, কোনোটি ঠিকাদারদের তৎপরতায়। এখন প্রকল্পগুলো দেশের মানুষের জন্য বোঝায় পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকার যে ১৮ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ রেখে গেছে, তার একটি অংশ দিয়ে এমন ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল।
রেললাইন প্রকল্পগুলোর নির্মাণ ব্যয় ও মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই আট প্রকল্পের ছয়টি বাস্তবায়নে নিয়োজিত ছিল চীনের কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পাঁচটিতে তাদের অংশীদার ছিল বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান। দুটিতে কাজ করেছে ভারতীয় ঠিকাদার।
এগুলো নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৭১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। কিন্তু সুফল কম। ফলে রেললাইনগুলোকে বলা হচ্ছে ‘সাদা হাতি’। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে ম্যাক্স গ্রুপ ও তমা কনস্ট্রাকশন।
সূত্র বলছে, মূলত বাংলাদেশি প্রভাবশালী ঠিকাদারেরা কাজ পাওয়ার যোগ্যতা বাড়াতে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামনে রাখেন। কাজ পাওয়া এবং বাস্তবায়নে স্থানীয় ঠিকাদারেরাই মূল ভূমিকা পালন করেন। একমাত্র পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পে চীনা ঠিকাদার মূল ভূমিকায় ছিল।
বেশি কাজ পাওয়া তমা কনস্ট্রাকশনের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূঁইয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে অংশ নিয়ে তিনি পরাজিত হন। তমা কনস্ট্রাকশনের পেছনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম রয়েছেন বলে আলোচনা আছে। আত্মগোপনে থাকায় মির্জা আজমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সূত্র বলছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের ওই সব প্রকল্পের কোনোটি নেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়, কোনোটি অর্থায়নকারী কোনো দেশের পরামর্শে, কোনোটি ঠিকাদারদের তৎপরতায়। এখন প্রকল্পগুলো দেশের মানুষের জন্য বোঝায় পরিণত হয়েছে।
প্রতিযোগিতা করে বেশি কাজ পাওয়া দোষের কিছু নয় বলে দাবি করেন তমা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মির্জা আজম তাঁর প্রতিষ্ঠানের অংশীদার নন। তবে তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু। ঘনিষ্ঠতার কারণে মানুষ অপপ্রচার করে।
অবশ্য রেল, সড়ক, নৌসহ বিভিন্ন খাতে বিগত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তমা কনস্ট্রাকশন। অভিযোগ আছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে তারা বেশি কাজ পেত।
রাজবাড়ী থেকে টুঙ্গিপাড়া রুটে ৭৮ কিলোমিটার পুরোনো রেললাইন সংস্কার এবং ৪৪ কিলোমিটার ব্রডগেজ মেইন ও ৮ কিলোমিটার শাখা লাইন নির্মাণের জন্য প্রকল্প অনুমোদন হয় ২০১০ সালে। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ২ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। কাজ শেষ হয় নির্ধারিত সময়ের পাঁচ বছর পর, ২০১৮ সালে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, শেখ হাসিনার ইচ্ছায় কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই এ প্রকল্প নেওয়া হয়। এই পথে নতুন রেলপথ, সেতু ও স্টেশন ভবনসহ অবকাঠামো নির্মাণের মূল কাজ করেছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, শেখ হাসিনার আগ্রহে ফরিদপুরের মধুখালী থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে মাগুরা পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এটিও নেওয়া হয়েছে সমীক্ষা ছাড়া। ব্যয় ১ হাজার ২০২ কোটি টাকা। প্রকল্পটির আওতায় প্রায় ২৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ ও বাংলাদেশের ক্যাসল কনস্ট্রাকশন।
ক্যাসল কনস্ট্রাকশন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ কাজী নাবিল আহমেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। অবশ্য রেল, সড়ক, নৌসহ বিভিন্ন খাতে বিগত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তমা কনস্ট্রাকশন। অভিযোগ আছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে তারা বেশি কাজ পেত।
পাবনার ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে ২০১০ সালে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। যদিও ২০১৮ সালে রেললাইনটির কাজ শেষ হয়। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৮৩ কোটি টাকা। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭১৫ কোটি টাকায়। এ পথে রেললাইন নির্মাণে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা হয়নি। উদ্বোধনের পর দুই বছর রেললাইনটি দিয়ে কোনো ট্রেনই চলেনি। ২০২০ সালে ‘ঢালারচর এক্সপ্রেস’ নামে এক জোড়া ট্রেন চালু করা হয়। ট্রেনটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত চলে। যদিও চলার কথা ছিল ১০টি ট্রেন।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী প্রয়াত এ কে খোন্দকারের আগ্রহে। তাঁর বাড়ি পাবনায়। এই প্রকল্পে ঈশ্বরদী থেকে পাবনা অংশের কাজ করে ম্যাক্স গ্রুপ। পাবনা থেকে ঢালারচর অংশের ঠিকাদার ছিল মীর আক্তার ও ভারতের র্যানকেন (যৌথ)।
উদ্বোধনের পর দুই বছর রেললাইনটি দিয়ে কোনো ট্রেনই চলেনি। ২০২০ সালে ‘ঢালারচর এক্সপ্রেস’ নামে এক জোড়া ট্রেন চালু করা হয়। ট্রেনটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত চলে। যদিও চলার কথা ছিল ১০টি ট্রেন।
পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। গত বছর রেলপথটির একাংশ চালু হয়েছে। আগামী নভেম্বরে পুরোটাই চালু হওয়ার কথা।
প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ আছে, নতুন এই রেলপথ চালু হলে প্রতিদিন ২৪ জোড়া বা ৪৮টি যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারবে। গত নভেম্বর ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এখন এই পথে ১০টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। মালবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি। আগামী নভেম্বরে যশোর পর্যন্ত চালু হলে কিছু যাত্রীবাহী ও দু-একটি মালবাহী ট্রেন চালুর পরিকল্পনা আছে রেলের। তবে জনবলের অভাব, ইঞ্জিনের সংকটসহ নানা কারণে তা কতটা সম্ভব—এ বিষয়ে নিশ্চিত নন রেলের কর্মকর্তারা।
২০১৮ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা (৪৫৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার)। চীনের সঙ্গে জিটুজি (দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে) পদ্ধতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। চীনা সরকার দিচ্ছে ২৬৭ কোটি ডলার (মোট ব্যয়ের ৫৮ শতাংশ)।
পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। চায়না রেলওয়ে গ্রুপকে ঠিক করে দেয় সে দেশের সরকার। ঠিকাদারের সঙ্গে দর-কষাকষি করে ব্যয় নির্ধারণ করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। এই প্রকল্প নিয়ে বড় অভিযোগ, প্রতিযোগিতা না থাকায় নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি পড়েছে।
প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ আছে, নতুন এই রেলপথ চালু হলে প্রতিদিন ২৪ জোড়া বা ৪৮টি যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারবে। গত নভেম্বর ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এখন এই পথে ১০টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। মালবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি।
যোগাযোগ-পরিবহন খাতে নির্মাণ ব্যয় নিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা তথ্যভান্ডার এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট আউটলুক (এটিও) অনুযায়ী, বাংলাদেশের পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ কোটি ৬৪ লাখ পিপিপি (ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) ডলার। ভারত, মালয়েশিয়া ও চীনের কয়েকটি রেলপথের নির্মাণ ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেশি।
২০১৬ সালে পণ্য পরিবহনের জন্য বিশেষায়িত একটি রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু করে ভারত। ওয়েস্টার্ন ডেডিকেটেড ফ্রেইট করিডর নামের এ রেলপথের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৫৩৪ কিলোমিটার। এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট আউটলুকের হিসাব অনুসারে, রেলপথটির কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় মাত্র প্রায় ৯৩ লাখ ডলার। পদ্মা সেতুর রেলসংযোগে কিলোমিটারপ্রতি এর আট গুণ ব্যয় পড়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পটি লাভজনক হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এটির চেয়েও বেশি ব্যয় করে নেওয়া পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পটি সাদা হাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে।
রেলপথ নির্মাণে বেশি ব্যয় ও বিপুল বিনিয়োগ করার পরও সুফল না পাওয়ার বিষয়টি জেনেছেন বলে উল্লেখ করে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ভবিষ্যতে যেনতেনভাবে কোনো প্রকল্প নেওয়া হবে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে লুটপাট হয়েছে। এর প্রতিটি প্রকল্পের তদন্ত করা হবে।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকায়। গত ডিসেম্বরে নতুন এই রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। ঢাকা থেকে কক্সবাজারে দুটি ট্রেন চারবার আসা-যাওয়া করে। এর বাইরে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি ট্রেন দুবার আসা-যাওয়া করে। তবে সেটি নিয়মিত নয়।
অথচ প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, সারা দেশ থেকে কক্সবাজারে যত পর্যটক যান, এর অন্তত ৫০ শতাংশ পাবে রেল। চালুর প্রথম বছরই যাত্রী পরিবহন করে ৩৯২ কোটি টাকা ও পণ্য পরিবহন করে ৫০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হবে।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত ঘুমধুম গুনদুম পর্যন্ত রেললাইন নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। লক্ষ্য ছিল চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে রেলপথে যুক্ত হওয়া। কিন্তু মিয়ানমারের অনাগ্রহে কক্সবাজার থেকে বাকি ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়। অর্থাৎ কনটেইনার পরিবহন করে আয়ের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।
এই রেলপথের কাজ দুই ভাগে বিভক্ত করে ঠিকদার নিয়োগ দেওয়া হয়। দোহাজারী-চকরিয়া অংশের কাজ করে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন ও বাংলাদেশের তমা গ্রুপ। চকরিয়া-রামু-কক্সবাজার অংশের কাজ করেছে চায়না সার্টিফিকেশন অ্যান্ড ইন্সপেকশন কোম্পানি ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার।
ভারতীয় ঋণে খুলনা থেকে মোংলা এবং আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত দুটি নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। গত বছর ১ নভেম্বর দুটি রেলপথ উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। উদ্বোধনের ছয় মাস পর গত মে মাসে খুলনা-মোংলা পথে একটি ট্রেন চলাচল শুরু হয়। আখাউড়া-আগরতলা ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি।
অথচ ২০১০ সালে ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা–মোংলা রেললাইন প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, মোংলা বন্দরকে রেলসংযোগের আওতায় আনার মাধ্যমে অর্থনীতিতে ‘নীরব বিপ্লব সাধিত হবে’। তিন বছরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। লেগেছে ১৩ বছর। পাঁচবার প্রকল্প প্রস্তাবে সংশোধন আনার পর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, খুলনা-মোংলা ও আখাউড়া-আগরতলা রুটে রেললাইন নির্মাণের প্রকল্প দুটি নেওয়া হয়েছে ভারতের আগ্রহে। প্রকল্পে তাদের পরামর্শক ও ঠিকাদারেরা কাজ করেছে। মালামালও বেশির ভাগ ভারত থেকে এসেছে।
রেলের এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সময় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রয়াত সৈয়দ আবুল হোসেন, ওবায়দুল কাদের, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মুজিবুল হক ও নুরুল ইসলাম সুজন। তাঁরা রেলকে লাভে আনতে পারেননি, সেবার মানেও তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বরং বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেল লোকসান দিয়েছে ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়। ওবায়দুল কাদের, মুজিবুল হক ও নুরুল ইসলাম সুজন এখন আত্মগোপনে। মুঠোফোনে তাঁদের পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, রেলের অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ঠিকাদারতাড়িত (ড্রিভেন)। ফলে এখানে লাভ–লোকসান কিংবা জনগণের জন্য কতটা উপযোগী, সেই প্রশ্ন শুরুতেই মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। এতে রাজনীতিক ও ঠিকাদারদের দুষ্টচক্র লাভবান হয়েছে। মানুষের লাভ হয়নি
আপনার মতামত জানানঃ