প্রতিদিনই প্রবাসীদের মরদেহ আসছে বাংলাদেশে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রবাসী এসব কর্মীর মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক ও হৃদরোগ। গত বছর বিভিন্ন দেশে মারা যাওয়া প্রবাসীদের মধ্যে ফেরত এসেছে ২ হাজার ৮৮৪ জনের মরদেহ। এর অর্ধেকের বেশিই এসেছে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া থেকে। প্রবাসী কর্মীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু তদন্তে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর কোনো উদ্যোগ নেই।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩২টিরও বেশি দেশ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ২ হাজার ৮৮৪ জন কর্মীর মরদেহ। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে এসেছে সর্বোচ্চ ৭৬২ জন প্রবাসীর মরদেহ। সৌদি আরবের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী কর্মীর মরদেহ ফিরিয়ে আনা হয়েছে মালয়েশিয়া থেকে। গত বছর দেশটি থেকে ফেরত এসেছে মোট ৬৯৬ জন প্রবাসীর মরদেহ।
এ দুটি দেশের বাইরে কুয়েত থেকে ২৭২ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২৪৭, বাহরাইন থেকে ৮২, কাতার থেকে ১৬৪, ওমান থেকে ২৮০, সিঙ্গাপুর থেকে ২৭, জর্ডান থেকে ২৫, যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ১২, ইতালি থেকে ৩৪, লেবানন থেকে ৫৫, গ্রিস থেকে পাঁচ, মালদ্বীপ থেকে ২৩, মরিশাস থেকে ১৮, স্পেন থেকে চার, ইরাক থেকে ৩০, লিবিয়া থেকে ১৩ জন প্রবাসীর মরদেহ ফেরত এসেছে। এছাড়া বাকি মরদেহগুলো এসেছে অন্যান্য দেশ থেকে।
প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে এমন বেশ কয়েকটি সংগঠন জানায়, গত চার বছরে যত প্রবাসীর লাশ এসেছে, তাদের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অন্তত ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যু হয়েছে আকস্মিকভাবে। স্ট্রোকজনিত কারণে প্রবাসীদের অকালমৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, দিনে ১২-১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং ধার করে বিদেশ যাওয়ায় টাকা উপার্জনে মানসিক চাপ তাদের মৃত্যুর জন্য অনেকাংশে দায়ী।
দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ায় শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছেন শরীয়তপুরের শাহ আলম হাওলাদার জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিবাসী কর্মীরা ঋণ নিয়ে বিদেশে যায়। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পর যে বেতনের কথা তাদের বলা হয়, তা তারা পায় না। এ ঋণের বড় বোঝার চাপ মানসিক চাপের সঙ্গে হাড়ভাঙা পরিশ্রম যোগ হয়। এভাবে শারীরিক ও মানসিক চাপে হার্টঅ্যাটাক করে মারা যান অনেক প্রবাসী শ্রমিক। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা ও অন্যান্য কারণেও প্রবাসীরা মারা যাচ্ছেন।
অভিবাসন খাত নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রবাসী কর্মীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু তদন্তে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর কোনো উদ্যোগ নেই। তাদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও নেই কোনো নজরদারি। বছরের পর বছর অস্বাভাবিক মৃত্যু বাড়তে থাকলেও তা প্রতিরোধে সরকার সক্রিয় হচ্ছে না বলে তারা অভিযোগ করেছেন। দায়সারাভাবে পরিবারকে মৃত্যুর কারণ বলে দেওয়াটা খুব অসম্মানজনক। মৃত্যুর কারণ অবশ্যই সরকারিভাবে যাচাই করা এবং তা প্রতিরোধে উদ্যোগী হওয়া উচিত।
প্রবাসে বৈধভাবে কর্মরত অবস্থায় যেসব শ্রমিক মারা যান, তাদের মরদেহই মূলত পরিবহনের ব্যবস্থা করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এজন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে লিখিতভাবে আবেদন করতে হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে প্রতিনিয়ত যেসব বৈধ প্রবাসী কর্মীর মরদেহ পৌঁছায়, তাদের দাফন ও পরিবহনের জন্য বিমানবন্দর থেকেই স্বজনদের হাতে ৩৫ হাজার টাকার চেক দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জাতীয় অর্থনীতির বুনিয়াদ অনেকাংশেই বৈদেশিক কর্মসংস্থানের উপর নির্ভরশীল। লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের ঘামঝরানো শ্রমের বিনিময়ে পাঠানো বৈদেশিক মূদ্রায় দেশের অর্থনীতি ও সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের গতি সচল থাকলেও এসব শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকারী কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বশীলদের ভ‚মিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশ গমনে সরকারী নিয়ন্ত্রণ এবং নীতিমালা বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা না থাকায় আদম বেপারী ও দালালদের মাধ্যমে অবৈধ পন্থায়, কয়েকগুণ বেশী টাকা খরচ করে বিদেশ যাওয়ার কারণেই বেশীরভাগ শ্রমিক মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। জমি-জিরাত বিক্রি করে, এনজিও থেকে চড়াসুদে ঋণ নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর প্রত্যাশিত মজুরী না পাওয়া, দু-চার বছরেও ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারা এবং নিয়োগকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে অমানবিক আচরণ ও নির্যাতনের শিকার হওয়াকেই প্রবাসে স্ট্রোক ও হৃদরোগে মৃত্যুবরণের জন্য দায়ী। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকেই বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে । বিদেশ গমনের জন্য নির্ধারিত খরচের পরিমাণ কমালে বা সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে সহায়তা করলে টেনশনে এমন মৃত্যুর হার কমবে । অভিবাসনের যে খরচ সেটি না থাকলে তাদের মধ্যে এই টেনশন কাজ করবে না। খরচ তুলে আনার বিষয়ে যে অস্থিরতা তাদের মধ্যে কাজ করে এটি আর থাকবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১২৫৩
আপনার মতামত জানানঃ