বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা কর দিয়ে বৈধ করেছেন ৭ হাজার ৪৪৫ জন করদাতা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। চলতি বছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় সম্পর্কিত আইনে পরিবর্তন আসায় করদাতারা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করতে উৎসাহিত হয়েছেন বলে অনেকেই মনে করছেন।
কালো টাকা সাদা করার নৈতিকতা এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। অনেকদিন ধরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকলেও চলতি বছরে এ সুবিধা গ্রহণের এ উল্লম্ফন নতুন করে অর্থনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। অন্যদিকে, কভিড-১৯ অতিমারীতে সরকারের ব্যয় চাহিদা বেড়ে গেছে। এ কারণে রাজস্ব আহরণ বাড়ারও প্রয়োজন রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে কর আহরণ বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সামাজিক আন্দোলন, তথ্যের স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।
এসব মন্তব্যসহ অপ্রদর্শিত আয় বৈধ হওয়ার ফলে দেশের অর্থনীতির কি প্রকৃতপক্ষে লাভ হচ্ছে, না লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হচ্ছে, তা নিয়ে নানা দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্ম, বাংলাদেশের ভার্চুয়াল বৈঠকে। ‘কালো টাকা সাদা হচ্ছে: অর্থনীতির লাভ, না ক্ষতি?’ শীর্ষক সংলাপটি গতকাল অনুষ্ঠিত হয়। প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় সংলাপে রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, উন্নয়ন কর্মী ও সাংবাদিকরা অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে এ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৯৬২ কোটি টাকার কর আদায় হয়েছে। এটি যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। এত বেশি টাকা কেন সাদা হচ্ছে। ব্যাপারটা কি এই, কালোটাকার পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে, নাকি প্রণোদনা বেশি কার্যকর হচ্ছে। দেবপ্রিয় প্রশ্ন তোলেন, এই টাকা কারা সাদা করছেন—ছোটরা নাকি বড়রা? কোন খাতে এই টাকা সাদা হচ্ছে। এর তাৎপর্য কী, জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে এর প্রভাব কী, তা বুঝতে হবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকার যে সুযোগ দিয়েছে তাকে কোনো নীতি বলা ঠিক হবে না। এটি একধরনের ব্যতিক্রম উদ্যোগ। এ ধরনের উদ্যোগ যত বেশি হবে, মূল ধারার কার্যকারিতা তত কমবে। এ উদ্যোগ সাম্য, নীতি, সংবিধান এবং সৎ করদাতা পরিপন্থি। উন্নয়ন ও সাম্যবিরোধী। এর ধারাবাহিকতা থাকা ঠিক হবে না। এ বছরই এ সুযোগ বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কালো টাকা মূল ধারায় আনার জন্য তিনি ‘বেনামি সম্পত্তি ঘোষণা আইন’ করার প্রস্তাব করেন।
অনুষ্ঠানে ‘কালোটাকা সাদা হচ্ছে: অর্থনীতির লাভ না ক্ষতি’ শীর্ষক এক উপস্থাপনা তুলে ধরেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি জানান, হংকং, ফিলিপাইন, ইরান, নিকারাগুয়া, বলিভিয়ার মতো দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে। প্রথম পর্বে এই সব দেশ কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু একপর্যায়ে তারা শক্ত হাতে কালোটাকার উৎস বন্ধ করেছে। ফলে সেসব দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে চমকপ্রদ গতি এসেছে।
পাকিস্তান আমল থেকেই করছাড় দেওয়ার চল শুরু হয়েছে বলে জানান সিপিডির চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, একটি সময় কেবল এই সুযোগ ছিল না, সেটা হলো, বঙ্গবন্ধুর জমানায়। কালোটাকা সাদা করার সুযোগের বিশেষ ফল আসছে না। বাড়ছে না দেশের কর-জিডিপির অনুপাত। রেহমান সোবহান বলেন, কলকাতার মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা জন্মলাভের সঙ্গে কালোটাকা সাদা করার বুদ্ধিও শিখে ফেলে। মুম্বাইয়ের যে চলচ্চিত্রশিল্প, সেটাও চলে মূলত কালোটাকার শক্তিতে। এই টাকা ব্যয় হয় নির্বাচনে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, এভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া সৎ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অন্যায়ের শামিল। তবে এই টাকাটা দেশের ভেতরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আবাসন খাতসহ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হচ্ছে। শেয়ারবাজারে এখন দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ২০০৯ সালেও এ রকম হয়েছিল, পরে বাজার ধপাস করে পড়ে যায়।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, হুন্ডি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা হচ্ছে। দুদক, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এর জন্য দায়ী। কালোটাকা প্রতিরোধের সবচেয়ে টেকসই উপায় হিসেবে তারা বলেন, এনবিআরকে শক্তিশালী করতে হবে। সে জন্য দরকার বিনিয়োগ। কিন্তু কোনো সরকারই এ খাতে বিশেষ নজর দেয়নি। উন্নয়ন যা হয়েছে, তা দাতাদের জোরাজুরিতে। সরকারের তাতে বিশেষ অংশগ্রহণ নেই।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করায় জোর দেন। তিনি জানান, এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠানে এক টাকা বিনিয়োগ করা হলে ৫০ টাকা ফেরত পাওয়া যায়। অথচ বাংলাদেশের এনবিআরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিশেষ নজর নেই। তারা অনেক বছর লোকবল নিয়োগ করতে পারেনি। এ ছাড়া কালো টাকা বন্ধে প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দেন তিনি। বলেন, ভারতে যেকোনো ধরনের লেনদেনে আধার কার্ডের নম্বর ব্যবহার বাধ্যতামূলক, দেশেও তেমন ব্যবস্থা করতে হবে। প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করার বিকল্প নেই বলে তিনি মনে করেন।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান ও কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বর্তমান কালো টাকা সাদা করার সুযোগের থেকে সৎভাবে কর দেওয়া বেশি ব্যয়বহুল। এই সুযোগের কারণে মানুষ সৎভাবে কর দিতে নিরুৎসাহিত হতে পারে।
মাল্টিমোড গ্রুপের ডেপুটি সিইও তাবিথ আউয়াল বলেন, কালো টাকার চক্র আছে। মাদক, অস্ত্র, রিয়েল এস্টেট ব্যবসাসহ নানা ক্ষেত্রে এ চক্র সক্রিয়। রাজনীতিতে নীতির ঘাটতির কারণে চক্রটি শক্তিশালী। জমি, প্লট, ফ্ল্যাটের মতো কালো টাকার উৎসেই আবার তা বিনিয়োগ করে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এই নীতি থেকে বের না হলে কালো টাকার উৎস বন্ধ হবে না।
আইবিএফবির সহসভাপতি এম এস সিদ্দিকী বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ মৌলিক অধিকার এবং সুশাসনের পরিপন্থি। তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণ বাড়াতে দক্ষ রাজস্ব প্রশাসন দরকার। পাশাপাশি অন্যান্য খাতেও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এমপ্লয়ারস ফেডারেশনের সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, প্রথমে কালো টাকা ও অপ্রদর্শিত আয়ের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করতে হবে। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ বাড়ানো সম্ভব নয়।
আলোচনার সার সংক্ষেপ বর্ণনা করে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘কালো টাকা সাদা করার এই সুযোগ অন্যায্যবোধকে প্রশ্রয় দেয়। সীমিত আকারে ও স্বল্প সময়ের জন্য এই সুযোগ অর্থনীতির জন্য সহায়ক হলেও, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে তা বড় ক্ষতি নিয়ে আসে’।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪১
আপনার মতামত জানানঃ