কবির হোসেন : মিয়ানমারে সম্প্রতি ঘটা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে গেলো নাকি ঘটানো হলো এনিয়ে রয়েছে জোর গুঞ্জন। কেননা বিশ্ব রাজনীতির কবলে থাকা দেশগুলোর মধ্যকার বিরাট কোনো পরিবর্তন কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনাই যুক্ত থাকে না, এরচেয়ে বড় প্রভাবক হিসাবে কাজ করে বিশ্ব রাজনীতি। বিশ্লেষকদের অনেকেই একমত যে, মিয়ানমার ভৌগোলিক কারণে বিশ্ব রাজনীতির এক রকম কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। বিশ্ব রাজনীতির দুটি ব্লকেরই পাঁয়তারা রয়েছে মিয়ানমার প্রসঙ্গে। কে কার প্রভাব কতটা বজায় রাখতে পারছে এনিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। মূলত এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার নিয়ে চলে এই প্রতিযোগিতা।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে এক প্রতিষ্ঠিত অভিযোগ হলো, তারা করায়ত্ব করা যায় এমন দেশগুলোতে গণতন্ত্রের রমরমা ব্যবসা করে থাকেন। অর্থাৎ, গণতন্ত্রের নামে সৃষ্ট বিভাজন থেকে ফায়দা নেওয়ার কৌশল হিসেবে গণতন্ত্রের টোপ ফেলে থাকেন। মিয়ানমার প্রসঙ্গেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো তথা এ ব্লক রাজনৈতিক কারণেই মিয়ানমারের গণতন্ত্র তথা সুচি সরকারের সমর্থনে রয়েছে। সুচিকে নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তিতে সহযোগিতা, ২০১৫ সালের নির্বাচনে সুচির জয়লাভ, সুচিকে দেশটির মা হিসাবে প্রতিষ্ঠাসহ বহু কৌশলই নিয়েছে বলে তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা রয়েছে বিশ্ব পরিমণ্ডলে।
এতোকিছুর পরও যে মিয়ানমারকে পশ্চিমা দেশগুলো আয়ত্বে নিতে পেরেছে তেমনটা মনে করেন না আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। দীর্ঘদিনের সামরিক শাসনের বিলুপ্ত ঘটে মিয়ানমারের নির্বাচন প্রথা চালু হবার পর থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান ছিল চীন ও রাশিয়াই। মিয়ানমারের সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি সহ অনেক চুক্তিই রয়েছে চীন ও রাশিয়ার সাথে। এরপরেও দুইদিন আগে মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া সামরিক অভ্যুত্থান কোন দিকে গড়ালো, এনিয়ে চলছে জল্পনা।
২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে সুচি জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে জয়লাভ করার পর কেউ ভাবতেই পারেনি দেশটিতে আবারও সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে পারে। এর কারণ হিসাবে বিশ্লেষকরা তুলে ধরেন, দেশটিতে গণতান্ত্রিক সরকার থাকলেও সেনাবাহিনীর জন্য জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে সংসদে ২৫ শতাংশ সিট বরাদ্দ থাকে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র এবং সীমান্ত সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ও সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সংবিধানের মূল ধারাগুলো সংশোধনের ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনীর ভেটো প্রদানের ক্ষমতা আছে। অন্যদিকে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাতমাদাওদের অর্থনৈতিক স্বার্থেও কোনো হস্তক্ষেপ করা হয় না। বৃহৎ সামরিক বাজেট ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা থেকে আছে তাদের স্থিতিশীল আয়ের ব্যবস্থা। দেশের অভ্যন্তরে তারা যেকোনো বাণিজ্যিক প্রকল্পকেই কোনো আইনি বাধা ছাড়া আত্মবিশ্বাসের সাথে টেক্কা দিতে সক্ষম। কিন্তু যদি হাতে ক্ষমতা থাকেই তাহলে আবার কেন ক্ষমতা দখল?
এনিয়ে ভাবার আগে সাম্প্রতিক সময়ের বিশ্ব রাজনীতিতে কিছুটা ঘুরে আসা যাক। বিভিন্ন গবেষণার মারফতে এটা জানা গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে টপকে অচিরেই চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে রাজত্ব করতে যাচ্ছে। করোনা মহামারিকালীন বিশ্বের অন্যান্য দেশ অর্থনৈতিক সংকটে থাকলেও চীনের ছিল অনুকূলে। এদিকে চীন থেকে উদ্ভব করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো। এনিয়ে চীনের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে এক দ্বন্দ্ব বিরাজমান। তারই প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য চীনের কলোনি তাইওয়ান ও হংকং ইস্যুতে চক্রান্তে নামলে চীনও হুঁশিয়ারি করে দেয় কোনো ধরণের যুদ্ধ না বাঁধানোর।
এবিষয়ে দুই পক্ষেই চলছে টানটান উত্তেজনা। এরইমধ্যে মিয়ানমারে হঠাৎ বলা নাই কওয়া নাই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে গেলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা একে বিশ্ব রাজনীতিরই এক চতুর চাল হিসাবে ভাবতে বসেছেন। এর কারণ হিসাবে তারা তুলে ধরতে চাইছেন, মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানে পশ্চিমা দেশগুলো অনেকটা আহতস্বরেই নিন্দা জানিয়েছেন। এমনকি সামনের পরিস্থিতি ভালো হবে না বলেও হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নয়া প্রেসিডেন্ট বাইডেন বিশ্ব রাজনীতির অংশ হিসাবে মিয়ানমারকে হয়তো ট্রাম্প কার্ড হিসাবে ছক কষেছিলেন যা ব্যর্থ হওয়াতে যেন অনেকটাই আহত হয়েছেন। এদিকে পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানে তাৎক্ষণিক নিন্দা জানালেও চীন ও রাশিয়া এখনো তেমন কোনো বিবৃতি দেয়নি। যদিও বিশ্ব মিডিয়ার কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, সুচি সরকারের সাথে চীনের চলমান বাণিজ্য অনেকটাই ব্যহত হবে এই সামরিক অভ্যুত্থানে। এমনকি চীনা কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমও এমনটি জানিয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের কাছে মিয়ানমার ইস্যুতে এই মুহূর্তে বাণিজ্যের চেয়ে রাজনীতি মূখ্য হয়ে উঠেছে।
এরও কারণ হিসাবে তারা দেখছেন, গতকাল মঙ্গলবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠকে বসেছিল। মিয়ানমারের সেনা শাসকদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ যে যৌথ বিবৃতি দিতে চেয়েছিল তা প্রত্যাখ্যান করেছে বিশ্বরাজনীতির দুই প্রভাবশালী দেশ চীন এবং রাশিয়া। জাতিসংঘে তাদের এই অসমর্থনও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। নিরাপত্তা পরিষদ থেকে কোনো দেশের বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতির জন্য চীনের সমর্থন লাগে। দেশটি পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ায় ভেটো ক্ষমতার অধিকারী।
এদিকে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানে চীনের চেয়েও বেশি লাভমান হবে রাশিয়া। পশ্চিমা নজর থেকে কেবল রাশিয়াকে বাঁচানোই নয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাশিয়ার অন্যতম অস্ত্র ক্রেতা। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি রাশিয়ায় গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে ঘটে যাওয়া বিপ্লবে পশ্চিমা দেশের হাত রয়েছে মর্মে অভিযোগ ওঠে। রাশিয়ার ঘটা বিদ্রোহে দেশটির ভিত কেঁপে উঠেছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ পুতিন বিরোধী স্লোগানে রাস্তায় নেমেছিল আর পুতিন প্রশাসনও হাজার হাজার বিদ্রোহী আটক করে জেলে পুরেছে। এমনকি এই বিদ্রোহ যাকে নিয়ে, মূলহোতা বিরোধী দলের নাভানলিকেও সাড়ে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে পুতিন প্রশাসন। রাশিয়ায় সংগঠিত বিদ্রোহে রাশিয়াকে পশ্চিমা রাজনীতির কবলমুক্ত করার জন্যও মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এর কারণ হিসাবে তারা মনে করেন, মিয়ানমারে যে কারণগুলো সামনে রেখে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানে নামলো, সেসব অভ্যুত্থান ঘটানোর মতো তেমন শক্তিশালী নয়। ২০২০ সালের নির্বাচনে সুচি জয়লাভ করলে উক্ত নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলে সেনাবাহিনী। তারা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে পুনরায় নির্বাচন দাবি করে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব অভিযোগ অনেকটাই বাইডেনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের অভিযোগ। কেননা, নির্বাচনে সুচি ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। সর্বৈভ ক্ষমতার অধিকারী সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব বজায় থাকা দেশটিতে কারচুপির অভিযোগটি তারা মেনে নিতে চান না।
কারচুপির অভিযোগ ছাড়াও আরো কয়েকটি কারণে সামরিক অভ্যুত্থান হয়ে থাকতে পারে বলে অনেকে চিহ্নিত করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, গত নভেম্বরের নির্বাচনে সুচির দল এনএলডি জয়লাভ করে। সেই সাথে হাতে পায় দ্বিতীয় মেয়াদে দীর্ঘকালীন কর্তৃত্ব। দেশটির সেনাবাহিনীর কাছে মনে হচ্ছিল ক্ষমতার পাল্লা ভারসাম্য হারিয়ে এখন এনএলডির দিকে ঝুঁকছে। সেনাবাহিনীর অশেষ ক্ষমতার জন্য নিশ্চিতভাবেই তা হুমকিস্বরূপ। সামরিক জান্তার পায়ের মাটি সরে যাওয়ার আগেই অভ্যুত্থানটি ছিল এক প্রতিরোধমূলক আঘাত।
তবে একটা বিষয়ে খটকা লাগবে। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও অং সান সুচির দল আইনি, অর্থনৈতিক কিংবা সাংবিধানিকভাবে সামরিক ক্ষমতা হ্রাস করা থেকে বিরত ছিল। এমনকি সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে তাদেরই অধীনে সুচির সরকার দেশ পরিচালনা করছিল মর্মেও আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা ছিল।
সামরিক অভ্যুত্থানের আরেকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যক্তিগতভাবে জেনারেল মিন অং হ্লাইং এর জন্য অভ্যুত্থানটির প্রয়োজন ছিল বলে অনেকে তুলে ধরছেন। এবছর হ্লাইং-এর অবসরে যাওয়ার কথা। পাঁচ বছর আগে ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য তিনি অবসরের বয়স ৬০ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ করেন। কূটনীতিকরা বলেছেন যে, ক্ষমতা ছাড়ার বিষয়ে হ্লাইং উদ্বিগ্ন ছিল। কেননা অবসরে যাওয়ার পর তাকে বহু কারণে আদালতের সম্মুখীন হতে হবে। বিশেষত রোহিঙ্গা মুসলিমদের জাতিগত নির্মূলে নেতৃত্বদানের অভিযোগে হ্লাইংকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হতে পারে।
বিশ্লেষকরা এই কারণটা ছুঁড়ে ফেলতে চান না অবশ্য। কেননা, সামরিক বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা নির্যাতনের পক্ষে সবসময়ই সমর্থনে ছিল চীন ও রাশিয়া।
তবে বিশ্লেষকরা মিয়ানমার ইস্যুতে এখানেই শেষ দেখছেন না। মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো ব্যক্তিগত ক্ষতি মনে করেই সামনের দিকে আগাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে সামরিক বাহিনীকে হুমকি-ধামকিও অব্যাহত রেখেছে। ব্যক্তিগত ক্ষতি হয়ে গেছে এমনিভাবে দেন দরবার শুরু করে দিয়েছে পশ্চিমাদেশগুলো। জাতিসংঘকে ব্যবহার করেও বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছে বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। তবে এসবের বাইরে একদম চুপচাপ আছে চীন ও রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিপরীতে যতটা তোড়জোড় করে যাচ্ছে ততোটাই নীরব আছে চীন ও রাশিয়া। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানান, মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলোর পুঞ্জিভূত ক্ষোভ যুদ্ধে রুপ লাভ করতে পারে। অথবা আসন্ন বিশ্ব রাজনীতিতে ব্যাপক হট্টগোলের অন্যতম কারণ হতে পারে মিয়ানমারের এই সামরিক অভ্যুত্থান।
এসডব্লিউ/১৬১২
আপনার মতামত জানানঃ