বিজয় দিবসের মাত্র দু’দিন পর ঢাকার রাত ভেঙে যে দৃশ্য সামনে আসে, তা বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক পরিসরের জন্য এক ভয়ংকর সতর্কবার্তা হয়ে ওঠে। প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার এবং ছায়ানটের মতো শীর্ষ ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে একের পর এক মব হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ শুধু তাৎক্ষণিক সহিংসতার ঘটনা নয়—বরং এর ভেতর দিয়ে রাজনীতি, আদর্শিক সংঘাত, রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা এবং দীর্ঘদিনের জমে থাকা ভারতবিরোধী মনোভাবের জটিল সমন্বয় প্রকাশ পেয়েছে। হামলাকারীদের স্লোগান, বক্তব্য ও টার্গেট বাছাই দেখলে স্পষ্ট হয়, এটি নিছক ক্ষোভের বিস্ফোরণ নয়; বরং একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বয়ানকে সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে ভয় ও দমন তৈরি করার প্রচেষ্টা।
এই সহিংসতার কেন্দ্রে রয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও মুখপাত্র ওসমান হাদির মৃত্যু। তার হত্যাকাণ্ডের পরপরই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে নানা দাবি—হত্যাকারী ভারতে পালিয়েছে, ভারত এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে, কিংবা ভারতপন্থী শক্তিরাই দেশে ‘প্রকৃত স্বাধীনতার’ পথে বাধা। এই দাবিগুলোর কোনোটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত না হলেও সেগুলো খুব দ্রুত একটি আবেগী ও আক্রমণাত্মক রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। সেই ভাষ্যের মূল উপাদান ছিল ভারতবিরোধিতা।
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই সীমান্ত হত্যা, পানিবণ্টন, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ ঘিরে এই মনোভাব নানা সময় প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে এই অনুভূতিকে যেভাবে সরাসরি সহিংসতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সংগঠিত ও বিপজ্জনক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশেষ করে গত বছরের জুলাই আন্দোলনের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ভারতে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে নতুন করে চাপের মুখে ফেলে। অনেকের চোখে ভারত তখন শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয়, বরং পতিত সরকারের রক্ষাকবচ হিসেবে হাজির হয়। শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার দাবি প্রত্যাখ্যাত হওয়া এবং পরবর্তীতে ওসমান হাদির হত্যার পর সন্দেহভাজনের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন—এই সবকিছু মিলিয়ে জনমনে ভারতের প্রতি ক্ষোভ আরও ঘনীভূত হয়। এই ক্ষোভই দ্রুত রাজনৈতিক শক্তিগুলোর জন্য একটি কার্যকর বয়ানে পরিণত হয়, যা ব্যবহার করে তারা নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চায়।
হামলার সময় যে স্লোগানগুলো শোনা গেছে—‘ভারতের দালাল’, ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’, ‘শাহবাগি’, ‘বামপন্থী’—সেগুলো কেবল অপবাদ নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট আদর্শিক শত্রু চিহ্নিত করার কৌশল। প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আসা গণমাধ্যম হিসেবে পরিচিত। ছায়ানট ও উদীচী বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতীক। ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করা মানে কেবল ভবনে আগুন দেওয়া নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ চিন্তাধারাকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। বিশ্লেষকদের মতে, ধর্মভিত্তিক ও কট্টর রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর জন্য ভারতবিরোধী স্লোগান এখানে দ্বিমুখী সুবিধা এনে দেয়—একদিকে তারা জনগণের বিদ্যমান ক্ষোভকে পুঁজি করে সমর্থন আদায় করতে পারে, অন্যদিকে নিজেদের আদর্শিক বিরোধীদের ‘বিদেশি দালাল’ আখ্যা দিয়ে আক্রমণকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে।
হামলার আগে ও পরে বিভিন্ন সমাবেশে ইসলামী ছাত্রশিবির ও সংশ্লিষ্ট নেতাদের বক্তব্য এই সহিংসতার রাজনৈতিক চরিত্রকে আরও স্পষ্ট করে। প্রকাশ্যে গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার আহ্বান, ‘তছনছ করে দেওয়ার’ হুমকি এবং ‘সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের’ নামে সহিংসতার ডাক—এসব বক্তব্য নিছক উত্তেজনাপূর্ণ ভাষা নয়, বরং সরাসরি উসকানির শামিল। যদিও পরবর্তীতে এসব বক্তব্যকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং সংগঠনের পক্ষ থেকে দায় অস্বীকার করা হয়েছে, তবু ঘটনার ধারাবাহিকতা ও টার্গেট বাছাই সেই অস্বীকৃতিকে দুর্বল করে দেয়।
এই পুরো ঘটনায় সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো রাষ্ট্রের ভূমিকা। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ অনুযায়ী, হামলার সময় নিরাপত্তা বাহিনী কার্যকরভাবে হস্তক্ষেপ করেনি। এমনকি গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করেও তাৎক্ষণিক সহায়তা পায়নি বলে অভিযোগ ওঠে। ডেইলি স্টারের ক্ষেত্রে তো দেখা যায়, ২৮ জন সাংবাদিক দীর্ঘ সময় ভবনের ছাদে আটকে ছিলেন, আর তাদের উদ্ধারে বিলম্ব হয়। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে হামলাকারীদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করতে দেখা যায়, যা অনেকের চোখে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের দুর্বলতার প্রতীক হয়ে ওঠে। এই নিষ্ক্রিয়তা বা বিলম্বের কারণে প্রশ্ন উঠছে—এটি কি কেবল অদক্ষতা, নাকি সরকারের ভেতরের কোনো অংশের নীরব সমর্থন?
অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমনিতেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের পথেই কেবল এই অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু সেই নির্বাচন যদি বানচাল করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে সহিংসতা ছড়ানো হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। অনেক রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধির আশঙ্কা, ভারতবিরোধী মনোভাবকে সামনে রেখে এক শ্রেণির শক্তি দেশে অরাজকতা তৈরি করতে চাইছে, যাতে নির্বাচন পিছিয়ে যায় বা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এই প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করা অত্যন্ত কৌশলগত—কারণ এগুলোই জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সম্পাদক পরিষদ, নোয়াব এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও নাগরিক সংগঠনের নিন্দা সত্ত্বেও এই ঘটনাগুলো একটি গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। এটি কেবল কিছু উগ্র গোষ্ঠীর সহিংসতা নয়; বরং দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং আদর্শিক সহনশীলতার অভাবের বহিঃপ্রকাশ। ভারতবিরোধিতা এখানে মূল কারণ নয়, বরং একটি কার্যকর হাতিয়ার—যার মাধ্যমে ভয়, বিভাজন ও সহিংসতা ছড়ানো হচ্ছে। এই হাতিয়ার যতদিন কার্যকর থাকবে, ততদিন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, স্বাধীন গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক পরিসর ঝুঁকির মুখে থাকবে।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন দাঁড়ায়—সমাধান কোথায়? বিশ্লেষকদের মতে, প্রথমত রাষ্ট্রকে স্পষ্টভাবে তার নিরপেক্ষতা ও কর্তৃত্ব প্রমাণ করতে হবে। সহিংসতার ঘটনায় দ্রুত ও দৃশ্যমান বিচার না হলে এই প্রবণতা আরও বাড়বে। দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, যাতে ভারতবিরোধী বা অন্য কোনো আবেগকে সহিংসতার উসকানি হিসেবে ব্যবহার করা না হয়। তৃতীয়ত নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে আরও সংহত হয়ে স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, যদিও তা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ইতিহাস দেখিয়েছে, যখন গণমাধ্যম ও সংস্কৃতিকে দমন করা হয়, তখন শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঢাকায় প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার ও ছায়ানটের ওপর হামলা তাই বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটি একটি বড় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে—বাংলাদেশ কি এমন এক পথে এগোচ্ছে, যেখানে ভিন্নমত মানেই শত্রু, আর রাজনৈতিক সুবিধার জন্য সহিংসতা বৈধ? ভারতবিরোধী মনোভাবের আড়ালে যে এই প্রশ্নটি চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে, সেটিই হয়তো সবচেয়ে বড় বিপদ।
আপনার মতামত জানানঃ