বাংলাদেশ আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি এমন এক নির্বাচনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, যা রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন মোড় তৈরি করতে পারে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও একই দিনে গণভোট—দুটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রথমবারের মতো একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। দীর্ঘ অনিশ্চয়তার পর যখন রাজনৈতিক অঙ্গনে স্পষ্টতার দাবি বাড়ছিল, তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণে এই তফসিল ঘোষণা করেন। তাঁর ভাষণ শুধু একটি নির্বাচনের তারিখ জানানো নয়; বরং ছিল একটি গভীর রাজনৈতিক বার্তা, যার মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা, সংস্কার এবং রাষ্ট্রের নতুন দিক নির্দেশনার ওপর জনগণকে আহ্বান জানালেন।
গত বছরের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নানা মোড় নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রশাসন, রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এবং জনগণের প্রত্যাশা—সবকিছুতে নতুন এক অস্থিরতা ও উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশন ও তফসিল ঘোষণাকে ঘিরে জনমনে এক ধরনের সংশয়ও দেখা দিয়েছিল। সিইসির ভাষণে সেই শঙ্কা নিরসন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের আহ্বান স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের লক্ষ্য একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন আয়োজন, যা কেবল দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করবে না, বরং বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উজ্জ্বল করবে। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চান—এই নির্বাচন শুধু সংখ্যার হিসাব নয়, বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের একটি আইকনিক মুহূর্ত। মনে করিয়ে দেন যে গণঅভ্যুত্থানের পরে জনগণ যে সংস্কারের প্রত্যাশা করছে, এই নির্বাচন সেই পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।
এবার নির্বাচনের দিনেই গণভোট। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ওপর হবে এই গণভোট—যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট সাদা, গণভোটের ব্যালট গোলাপি—এই ঘোষণা শুধু প্রক্রিয়াগত নয়, বরং একই দিনে দুটি গণতান্ত্রিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে জনগণকে দ্বৈত দায়িত্ব পালনের আহ্বান।
নির্বাচনের দিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে—যা এবার এক ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। একই দিনে দুটি ভোট গ্রহণকে বিবেচনায় রেখে এ অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়েছে। আর তফসিল ঘোষণার দুই মাস পর ভোট—বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এটি একটি ব্যতিক্রম। সাধারণত ৪০-৪৫ দিনের ব্যবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এবার দীর্ঘ সময় রাখায় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা বাড়তে পারে।
তফসিল ঘোষণার পর ঘোষণা করা হয়েছে মনোনয়ন জমা, বাছাই, আপিল, প্রত্যাহার, প্রতীক বরাদ্দ এবং প্রচারণা শুরুর বিভিন্ন সময়সীমা। ২৯ ডিসেম্বর মনোনয়ন জমা, ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত যাচাই-বাছাই, ৬ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত আপিল, ২০ জানুয়ারি প্রত্যাহারের শেষ সময়, ২১ জানুয়ারি প্রতীক বরাদ্দ এবং ২২ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল পর্যন্ত প্রচারণা চলবে। এই বিস্তারিত তফসিল প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা দাঁড় করিয়েছে।
সিইসি তাঁর বক্তব্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সব পক্ষের আন্তরিক অংশগ্রহণ ও সক্রিয় সহযোগিতার মাধ্যমেই নির্বাচন সফল হতে পারে। এর মধ্যে একটি স্পষ্ট বার্তা আছে—অনিশ্চয়তা ও ভয়ের রাজনীতি নয়, বরং প্রতিযোগিতা ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনাই নির্বাচন কমিশনের প্রত্যাশা। তিনি ভোটারদেরও নির্ভয়ে ভোট দিতে আসার আহ্বান জানান। এই বার্তা বিশেষ করে সেই সকল জনগোষ্ঠীর উদ্দেশে, যারা পূর্ববর্তী নির্বাচনে সহিংসতা, দমন-পীড়ন বা অনিয়মের অভিজ্ঞতায় ভোট দিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন।
সিইসির বক্তব্যে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে প্রবাসীদের ভোট। তিনি জানান, দীর্ঘদিনের প্রায় অকার্যকর পোস্টাল ভোটব্যবস্থা সংস্কার করা হচ্ছে এবং প্রথমবারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য কার্যকর ভোট আয়োজন করা হবে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি রাজনৈতিক ক্ষমতায় নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। এটি ভবিষ্যতে নির্বাচনের চরিত্রেও পরিবর্তন আনতে পারে।
সিইসি তাঁর বক্তব্যে সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের স্বচ্ছভাবে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। এ আমন্ত্রণ গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কাঠামোকে শক্তিশালী করার বার্তা বহন করে। অতীত নির্বাচনগুলোতে পর্যবেক্ষকদের কাজ বাধাগ্রস্ত হওয়া বা সীমিত থাকার বিষয়টি আলোচনায় ছিল। এবার সিইসির উন্মুক্ত অবস্থান ভবিষ্যতের নির্বাচন ব্যবস্থায় নতুন মানদণ্ড স্থাপন করতে পারে।
নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করেছে, এবং তফসিল চূড়ান্ত হওয়ার পরপরই সিইসির ভাষণ রেকর্ড করা হয়েছে। এটা বোঝা যায় যে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ নির্বাচনকে সফল করার জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
এই নির্বাচনকে ঘিরে কিছু বড় প্রশ্নও আছে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো কি সক্রিয়ভাবে অংশ নেবে? দ্বিতীয়ত, ভোটাররা কি নিরাপদ পরিবেশ অনুভব করবে? তৃতীয়ত, গণভোটের প্রশ্নে জনগণ কতটা সচেতন ও প্রস্তুত? এবং চতুর্থত, নির্বাচন কমিশন বাস্তবে কতটা নিরপেক্ষ, শক্তিশালী ও দক্ষ ভূমিকা রাখতে পারবে?
গত বছরের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিকে এক নতুন বাস্তবতায় এনে দাঁড় করিয়েছে। অনেক পুরোনো শক্তি দুর্বল হয়েছে, নতুন শক্তি উঠে এসেছে, আর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নিজেদের ভূমিকা পুনর্বিবেচনা করতে হয়েছে। ফলে এই নির্বাচন দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের একটি লিটমাস টেস্ট। এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই নির্বাচনের দিকে গভীর নজর রাখবে, কারণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
এই নির্বাচনে গণভোট সংযোজন ভবিষ্যত রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়াকে নতুন পথ দেখাতে পারে। গণভোটের মাধ্যমে জনগণের মতামতকে সরাসরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যা বাংলাদেশে খুব কম ব্যবহৃত একটি প্রক্রিয়া। এটি নতুন গণতান্ত্রিক চর্চা তৈরি করতে পারে।
সব মিলিয়ে, ১২ ফেব্রুয়ারি শুধু ভোটের দিন নয়; এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব এই প্রক্রিয়াকে বিশ্বাসযোগ্য রাখা। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব স্বচ্ছ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। আর জনগণের দায়িত্ব শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিয়ে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা। এই তিনটি শক্তি সমন্বিত হলে—যে সংকট ও অনিশ্চয়তা গত দেড় বছর ধরে দেশকে গ্রাস করেছিল—সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ একটি নতুন গণতান্ত্রিক অধ্যায় শুরু করতে পারবে।
আপনার মতামত জানানঃ