পাকিস্তানের রাজনীতির ভেতরে এখন এমন এক নিস্তব্ধ ঝড় বইছে, যার শব্দ বাইরে শোনা না গেলেও তার অভিঘাত টের পাওয়া যায় প্রতিটি দিনে, প্রতিটি ঘটনায়, প্রতিটি সরকারি সিদ্ধান্তে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের নাম উচ্চারণ করা হয় প্রায় ফিসফিস করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ছবি পোস্ট করা হলে তা মুহূর্তেই সরিয়ে নেওয়া হয়, টেলিভিশনের পর্দায় তাঁর পরিচয় দেওয়া হয় পরোক্ষ নামে—‘কাসিমের বাবা’। এ যেন এক বেখাপ্পা, অদৃশ্য সেন্সরশিপের যুগ, যেখানে একটি মানুষকে জনস্মৃতি থেকে মুছে ফেলার প্রকল্প চলছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। অথচ সেই মানুষটাই কয়েক বছর আগেও পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক চরিত্র, বিশ্বকাপজয়ী নায়ক এবং পরিবর্তনের প্রতীক ছিলেন। এখন তাঁর অবস্থান হচ্ছে কারাগারের ভেতরে, যেখানে পরিবার বা আইনজীবীদের সঙ্গে বহু সপ্তাহ যোগাযোগও করতে দেওয়া হয়নি। এই যোগাযোগহীনতার ফাঁক থেকেই জন্ম নিয়েছে তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে নানা গুজব—তিনি কি জীবিত আছেন, নাকি তাঁকে নিয়ে কোনো কঠোর সত্য আড়াল করা হচ্ছে?
সরকার অবশ্য বারবার বলছে, ইমরান খান সুস্থ আছেন। কিন্তু বক্তব্য যতবার এসেছে, সন্দেহও ততবার কাটেনি। ২০২৩ সাল থেকে কারাবন্দী অবস্থায় থাকা এই নেতা এখন পর্যন্ত ১৪ বছরের সাজা পেয়েছেন, আর তাঁর বিরুদ্ধে মোট মামলা সংখ্যায় পৌঁছেছে দেড় শতাধিক। অভিযোগের মধ্যে আছে রাষ্ট্রীয় উপহার চুরির অভিযোগ, দুর্নীতি, এমনকি সেনা সদর দপ্তরে হামলায় উসকানির অভিযোগও। দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর কারাবাস কয়েক দশক পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পাকিস্তানের ইতিহাসে যাঁরা রাজনীতির শিকার হয়েছেন, তাঁরা জানেন—কারাগারে যাওয়াটা এখানে প্রায় আনুষ্ঠানিক একটি ধাপের মতো। গত ৫০ বছরে এ দেশের প্রতিটি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কোনো না কোনো সময়ে কারাবাস করেছেন। ১৯৭৯ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল যে মামলায়, ৪৫ বছর পরে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে—এটি ছিল ন্যায়ের ঘাটতিতে ভরা এক বিচারের ফল।
এ কারণেই পাকিস্তানের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদেরা মনে করতেন, ইমরান খানের পথ শেষমেশ কারাগারেই গড়াবে। শুধু প্রশ্ন ছিল—কীভাবে এবং কখন। প্রথম দিকে তিনি ভেবেছিলেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস করে হয়তো বিদেশে নির্বাসনে যেতে পারেন, যেমন অতীতে অনেক নেতা গেছেন। কিন্তু পরের ঘটনাপ্রবাহ দেখিয়েছে, তাঁর কাছে সে পথ কখনোই খোলা ছিল না। কারণ সেনাবাহিনীর বর্তমান নেতৃত্ব, বিশেষ করে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির, দেশটির রাজনৈতিক কাঠামোকে এমনভাবে পুনর্গঠন করেছেন, যেখানে ইমরান খানের মতো জনপ্রিয় ও অনমনীয় নেতার থাকার স্থান নেই।
জেনারেল মুনির সম্প্রতি এমন সব সাংবিধানিক পরিবর্তন করিয়েছেন, যা পাকিস্তানের ক্ষমতার ভারসাম্যকে নাটকীয়ভাবে বদলে দিয়েছে। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে তাঁর অধীনে আনা, সেনাপ্রধানের মেয়াদ বাড়ানো, আজীবন মামলা থেকে অব্যাহতি—এসব পরিবর্তন কার্যত তাঁকে প্রায় অটুট ক্ষমতার জগতে নিয়ে গেছে। এই বাস্তবতায় রাজনীতিবিদদের ভূমিকা হয়ে গেছে অনেকটাই প্রতীকী। তাঁরা কেউ কেউ সেনাবাহিনীর সমর্থন পেতে নিজেদের ক্ষমতার অংশীদারিত্বও তুলে দিয়েছেন। যেন তারা বলছে, ইমরানকে জেলে রাখুন, বাকি সব আমরা মেনে নেব। এতে গণতন্ত্রের ঘর আরও ফাঁকা হয়েছে, আর ইমরান খান হয়ে উঠেছেন এক ব্যতিক্রম—কারাগারে থেকেও যাঁর প্রভাব রাষ্ট্রযন্ত্রকে অস্বস্তিতে রাখে।
ইমরান খানকে রাজনৈতিক পরিসর থেকে সরিয়ে দিতে যে প্রচেষ্টা চলছে, তার লক্ষ্য শুধু তাঁকে নিস্তব্ধ করা নয়; বরং তাঁকে জনমনে অস্তিত্বহীন করে তোলা। কারাগারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখার ফলে তাঁর অবস্থান নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, আর সেই উদ্বেগই আবার তাঁর সমর্থকদের সংগঠিত করছে। দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থাকা তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলন এখন আদালত, মানবাধিকার সংস্থা, আন্তর্জাতিক অঙ্গন—সব জায়গায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। লন্ডন, বার্সেলোনা, ওয়াশিংটন ডিসি—দেশের ভেতরের মতো বাইরেও চলছে তাঁর মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ। কিন্তু তার কোনো ফল এখনো দৃশ্যমান নয়। কারণ পাকিস্তানের ক্ষমতার কাঠামো আজ এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে আন্তর্জাতিক চাপও খুব একটা কার্যকর হয় না।
সেনাবাহিনী ইমরানকে ক্ষমতায় তুলেছিল—এই তত্ত্ব পাকিস্তানে এখন সর্বজনবিদিত। নির্বাচনের আগে প্রতিপক্ষকে কারাদণ্ডে পাঠানো, অযোগ্য ঘোষণা করা, প্রশাসনের সমর্থন নিশ্চিত করা—এসব প্রক্রিয়া তাকে ক্ষমতায় পৌঁছাতে ভূমিকা রেখেছিল বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যেই সেই সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। ইমরান খান তাঁর জনপ্রিয়তা ও নীতিবোধে বিশ্বাস রেখে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেন। ক্রমে তিনি সামরিক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে থাকেন, যা পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রায় নিষিদ্ধ একটি পদক্ষেপ। সেনা সদর দপ্তরে তাঁর সমর্থকদের হামলা—যা তিনি উসকানি দেননি বলে দাবি করেন—সেটি সংঘর্ষকে চরম পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। রাষ্ট্র তাঁকে অভ্যুত্থান উসকানির দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং সেখান থেকেই শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়, যার অবস্থান এখন পর্যন্ত কারাগারের ভেতর।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—ইমরান খান কি আপস করে দেশে বা বিদেশে রাজনৈতিক কারারুদ্ধতা এড়াতে চান? উত্তর হলো—সম্ভবত চাননি। তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা বলে থাকেন, তিনি কখনোই সামরিক নেতৃত্বের কাছে মাথানত করতে চাননি। অথচ বাস্তবতা হলো—তাঁর কাছে এখন কোনো আলোচনার পথও খোলা নেই। পাকিস্তানি রাজনীতিতে রাজনীতিবিদরা প্রায়ই সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে মুক্তি পেয়ে থাকেন। কিন্তু ইমরানের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা বন্ধ। কারণ সেনাবাহিনী বুঝে গেছে, তিনি মুক্ত থাকলে তার জনপ্রিয়তার ঢেউ আবার রাজনীতিকে অচল করে দিতে পারে। তাই তাঁকে শুধু কারাগারে রেখে দেওয়া নয়—তাঁর নাম, তাঁর ছবি, তাঁর বক্তব্য সবকিছুই জনমানস থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে সেনাশাসিত প্রশাসন।
তবুও ইমরান খান এখনো দমে যাননি। কারাগারের ভেতর থেকেও তিনি সরকারের দুর্নীতি, সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকেন্দ্রীকরণ এবং জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলছেন। তাঁর আইনজীবীরা বারবার আদালতে যাচ্ছেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার দ্বারস্থ হচ্ছেন। তাঁর সমর্থকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত সক্রিয়, যদিও কর্তৃপক্ষ বারবার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করছে এবং পোস্ট মুছে দিচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে তিনি যতটাই কোণঠাসা, প্রতীকের দিক থেকে ততটাই শক্তিশালী হয়ে উঠছেন—এটাই ইমরান খানের রাজনৈতিক চরিত্রের বিশেষত্ব। তিনি বিশ্বাস করেন, পাকিস্তানের মানুষ অন্যায় দেখলে একদিন রাস্তায় নামবেই। যদিও বাস্তবে সেনা কর্তৃপক্ষের দমননীতির কারণে সেই আশার প্রতিফলন এখনো দেখা যায়নি।
কারাগারের বাইরে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নাটক চলছে আরও এক স্তরে। বর্তমান নেতারা, যাঁরা অতীতে নিজেও রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, তাঁরা এখন সেনাবাহিনীর প্রভাব প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করছেন। এতে তাদের রাজনৈতিক শক্তি কমছে, গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মুনিরের ক্ষমতা আইনসঙ্গত করে তোলা তাদের রাজনৈতিক হিসাবের অংশ হলেও তা ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে আরও সঙ্কুচিত করছে। যেন তারা ভাবছে, যে মুহূর্তে তারা সেনাবাহিনীর সাথে দূরত্ব কমাবে, সে মুহূর্তে ক্ষমতার স্থায়িত্ব পাবে। কিন্তু পাকিস্তানের ইতিহাস বলে, দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের সমঝোতা কোনো পক্ষের জন্যই স্থায়ী হয় না।
১৯৯২ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় করে ইমরান খান পাকিস্তানের ‘কিংবদন্তি’ হয়ে ওঠেন। তিনি নিজেকে ও তাঁর দলকে বারবার “cornered tiger”—কোণঠাসা বাঘ—উপমায় উল্লেখ করতেন। আজ সে ‘বাঘ’টিকে খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনী মনে করে, খাঁচার চাবিটি তারা এত দূরে ফেলে দিয়েছে যে কেউই আর তা খুঁজে পাবে না। আজ যে গুজব ছড়ায়—তিনি বেঁচে আছেন কি না—তা হয়তো অতিরঞ্জিত। কিন্তু সত্য হলো, তাঁকে নিস্তব্ধ করার চেষ্টা সত্য এবং পরিকল্পিত। পাকিস্তানের ক্ষমতার খেলায় তাঁর সাপ্তাহিক ‘গর্জন’ও বন্ধ করে দিতে চাইছে ক্ষমতাবানরা।
যে দেশটি একসময় নির্বাচনের প্রতিযোগিতা, ন্যূনতম গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা এবং শক্তিশালী বিরোধী রাজনীতির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, সেই দেশেই এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতার নাম উচ্চারণ করাও নিষিদ্ধ। ইমরান খান আজ কারাগারের ভেতর, তাঁর দল ভাঙা, তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কিন্তু তিনি এখনো পাকিস্তানের সবচেয়ে আলোচিত এবং সবচেয়ে অস্বস্তিকর রাজনৈতিক চরিত্র। তাঁকে সরিয়ে ফেলা সহজ নয়, কারণ তাঁর নাম রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞায় চাপা পড়লেও জনগণের স্মৃতিতে তিনি এখনো তীক্ষ্ণ উপস্থিত। আর পাকিস্তানের রাজনীতিতে একবার কোনো নাম স্মৃতিতে গেঁথে গেলে তা মুছে ফেলা যায় না—এ গল্প বারবারই সত্য হয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ