মানবসভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে কিছু আচরণ আছে, যেগুলো এতটাই ব্যক্তিগত, এতটাই নিকট-স্পর্শী যে তাদের উৎপত্তি অনুসন্ধান করাই এক রকম বৈজ্ঞানিক দুঃসাহস। তেমনই একটি আচরণ হলো চুম্বন। শত শত সংস্কৃতিতে এটি প্রেম, আদর, বন্ধুত্ব, আত্মিক সম্পর্ক বা স্রেফ সামাজিক রীতির অংশ। কিন্তু চুম্বনের উৎপত্তি কখন? মানুষের পূর্বপুরুষরা কি এ আচরণ করত? বিশেষত নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে আধুনিক মানুষের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হলে চুম্বন কি ছিল তাদের মিলনের অংশ? বহু দিন ধরেই এসব প্রশ্ন বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। সাম্প্রতিক গবেষণা কিন্তু সেই রহস্যের ওপর নতুন আলো ফেলেছে। নতুন এক বিস্তৃত গবেষণায় উঠে এসেছে—হ্যাঁ, মানুষ ও নিয়ান্ডারথালরা শুধু যৌনসম্পর্কেই লিপ্ত হয়নি, তারা চুম্বনও করত। প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে চুম্বনের যে প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা আমাদের মানব ইতিহাসকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
নতুন গবেষণাটি করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফ্লোরিডা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির একদল বিজ্ঞানী। তারা প্রাইমেট অর্থাৎ বৃহৎ এপ শ্রেণির প্রাণীদের আচরণ নিয়ে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেন। চুম্বনের উৎপত্তি কি আদিম প্রবৃত্তি, নাকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক আচরণ—তাই ছিল অনুসন্ধানের মূল প্রশ্ন। গবেষক ক্যাথরিন ট্যালবট জানিয়েছেন, মানুষের কেবল ৪৬ শতাংশ সংস্কৃতিতে চুম্বনের নথাবদ্ধ প্রমাণ আছে। অর্থাৎ পৃথিবীর বেশির ভাগ সমাজে এটি কখনো চর্চা করা হয়নি বা ভিন্নভাবে চর্চিত হয়েছে। কেউ মুখে মুখ দেয়, কেউ নাক ঘষে, কেউ মাথা ঠেকায়—সবই সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা বা প্রজননের অংশ হিসেবে। অনেক প্রাণীই এমন আচরণ করে—শিম্পাঞ্জি, বনোবো, গরিলা, এমনকি সাদা ভাল্লুক বা নেকড়েও। তাই প্রশ্ন উঠেছে—মানুষ কেন এবং কখন চুম্বনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ এক আচরণকে গ্রহণ করল? কারণ মুখোমুখি স্পর্শে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বাড়ে। কিন্তু প্রজননে এর সুবিধা সরাসরি চোখে পড়ে না।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই গবেষকেরা প্রাইমেট আচরণকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ করেন। তারা চুম্বনকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন—আক্রমণাত্মক নয়, মুখে-মুখে স্পর্শ, যার মধ্যে খাবার আদান–প্রদান নেই। এরপর জটিল পরিসংখ্যানভিত্তিক বাইসিয়ান মডেলিং ব্যবহার করে বিবর্তনের শাখায় শাখায় চুম্বনের সম্ভাব্য উৎস অনুসন্ধান করা হয়। মডেলটি এক কোটি বার চালানো হয় যাতে ফলাফল নিখুঁত হয়। ফলাফলে পাওয়া যায়—চুম্বনের উৎপত্তি আজ থেকে প্রায় দুই কোটি ১৫ লাখ থেকে এক কোটি ৬৯ লাখ বছর আগের এক পূর্বপুরুষে। এ পূর্বপুরুষ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল চারটি গ্রেট এপ গ্রুপ—ওরাংওটাং, গরিলা, প্যান (শিম্পাঞ্জি ও বনোবো), এবং হোমো—যার শেষ জীবিত প্রতিনিধি আধুনিক মানুষ।
অর্থাৎ মানুষের বিবর্তনশৃঙ্খলার বহু আগেই চুম্বনের মতো আচরণ বেঁচে ছিল। আর তাই নিয়ান্ডারথালের মতো আমাদের ঘনিষ্ঠ পূর্বপুরুষের ক্ষেত্রেও এমন আচরণের উপস্থিতি সম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের ও নিয়ান্ডারথালের মুখের জীবাণুর মিল বহু আগে থেকেই জানা ছিল। এই মাইক্রোবিয়াল সংঘর্ষ বা মিলন সম্ভব কেবল লালার মাধ্যমে। অর্থাৎ তাদের মধ্যে চুম্বন হয়েছিল—এ ব্যাখ্যা এখন অনেকটাই যৌক্তিক। মানুষ ও নিয়ান্ডারথালরা প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার বছর আগে মিলিত হয়েছিল। যৌনসম্পর্কের প্রমাণ আমাদের জিনমেই আছে। কিন্তু চুম্বন তাদের ঘনিষ্ঠতার অংশ ছিল কিনা—এই প্রশ্নই এতদিন ছিল অনিশ্চিত। এখন গবেষণা বলছে—হ্যাঁ, তারা চুম্বন করত, আদর করত, ঘনিষ্ঠ স্পর্শের সম্পর্ক বজায় রাখত।
তবে প্রতিটি ঘনিষ্ঠ আচরণই যে সম্মতিপূর্ণ ছিল—সে নিশ্চয়তা বিজ্ঞান দিতে পারেনি। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, প্রাগৈতিহাসিক যুগে সম্পর্ক সবসময়ই হয়তো সমতা বা পারস্পরিক ইচ্ছার ভিত্তিতে হতো না। পুরুষ-প্রধান গোত্রে জোরপূর্বক সম্পর্কের ঘটনাও ঘটতে পারে। কিন্তু যেখানে স্বেচ্ছা ছিল, সেখানে চুম্বন বা আলিঙ্গন মিলনের স্বাভাবিক অংশ ছিল—এটি অনুমান করা অযৌক্তিক নয়। চুম্বন কোনো জটিল সাংস্কৃতিক উদ্ভাবন নয়, বরং এর শেকড় রয়েছে জীববৈজ্ঞানিক আচরণে। কিন্তু চুম্বন কেন টিকে রইল লক্ষ বছর ধরে—এ প্রশ্নও আকর্ষণীয়।
একটি ধারণা হলো, চুম্বনের মূল উৎস গ্রুমিং আচরণ—গায়ের উকুন বা টিক সরিয়ে দেওয়া। শিম্পাঞ্জিদের মতো প্রাণীরা মুখ দিয়ে অন্যের গায়ের ময়লা বা পরজীবী তুলে নেয়। এই আচরণ থেকে ক্রমে ঘনিষ্ঠতার রূপান্তর ঘটে। আরেকটি ধারণা বলছে, চুম্বনের মাধ্যমে হরমোন ও রাসায়নিক সংকেত বিনিময় হয়—যেমন অক্সিটোসিন, ডোপামিন—যা প্রেম, অনুভূতি ও বিশ্বাস গঠনে ভূমিকা রাখে। তাই বিবর্তন চুম্বনকে বেছে নিয়েছে, কারণ এটি সম্পর্ক স্থাপন ও জোট গঠনে সহায়ক। আবার প্রাইমেট সমাজে শক্ত জোট টিকে থাকার অন্যতম ভিত্তি। ফলে একটি আচরণ যদি সম্পর্ক শক্তিশালী করতে সাহায্য করে, তবে তা বিবর্তনে টিকে যাওয়াই স্বাভাবিক।
নিয়ান্ডারথালরা মানুষের থেকে আলাদা হলেও খুব দূরের ছিল না। তাদের বুদ্ধি, শক্তি এবং শিকার দক্ষতা ছিল চমকপ্রদ। প্রমাণ বলছে, তারা পরস্পরের যত্ন নিত, অসুস্থ সদস্যকে সাহায্য করত, এমনকি মৃতদের দাফনও করত। অর্থাৎ তাদের জীবনে আবেগিক বন্ধন ছিল। তাই চুম্বনের মতো আচরণ তাদের কাছে অস্বাভাবিক ছিল—এটা ভাবাও কঠিন। বরং মানুষের সঙ্গে মেলে তাদের সামাজিক আচরণ। তাই মানুষ যখন ইউরোপ–এশিয়ায় বিস্তৃত হচ্ছিল, তখন নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে দেখা হওয়া, সান্নিধ্য, মেলামেশা এবং সম্পর্ক গড়ে ওঠা ছিল একেবারেই বাস্তব ঘটনা। এই সম্পর্ক কেবল প্রজননের উদ্দেশ্যে হয়নি; বরং ঘনিষ্ঠতা, স্পর্শ, স্নেহ—সবই এর অংশ ছিল। এভাবেই তাদের DNA আজও বহন করছে আধুনিক মানুষের শরীর।
মানুষের ইতিহাসকে প্রায়ই যুদ্ধ, প্রযুক্তি, অভিবাসন বা জলবায়ু পরিবর্তনের গল্প হিসেবে বলা হয়। কিন্তু চুম্বনের মতো একটি আচরণ যে কোটি বছর ধরে চলমান এক বিবর্তন-প্রবাহের অংশ, তা মনে করিয়ে দেয়—মানুষের গল্পে নরম অনুভূতি ও সম্পর্কের রূপরেখা বহু পুরোনো। কখনো আদিম প্রাণীর আচরণ থেকে, কখনো আবেগের সঞ্চার থেকে, আবার কখনো স্রেফ প্রয়োজন থেকে জন্ম নেওয়া এসব আচরণ আমাদের পরিচয় গড়ে তুলেছে। মানুষের সামাজিকতা, প্রেম, বন্ধুত্ব—যা–ই বলা হোক না কেন—সবকিছুর মূলেই রয়েছে এমন কিছু আচরণ, যা প্রাণীজগতে হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে। বিবর্তনের জটিল পথ পেরিয়ে আজও আমরা তা বহন করছি।
নতুন গবেষণা কেবল মানুষ-নিয়ান্ডারথাল সম্পর্ককে আরেকটি রোমাঞ্চকর মাত্রায় নিয়ে যায়নি, বরং আমাদের আচরণের গভীরে থাকা প্রাণীবৈজ্ঞানিক শেকড়ও স্পষ্ট করেছে। চুম্বনের ঝুঁকি আছে, রোগ ছড়ায়—তবু মানুষের সমাজে এটি টিকে আছে। অর্থাৎ সম্পর্ক, স্পর্শ, ঘনিষ্ঠতা—এসবের গুরুত্ব এতটাই বেশি যে বিবর্তন এসব আচরণকে রক্ষা করেছে। মানুষের DNA তে নিয়ান্ডারথালের যে চিহ্ন আজও আছে, তাতে চুম্বনের ভূমিকা থাকাটা তাই আশ্চর্য নয়। দুই প্রজাতির দেখা, সম্পর্ক, সান্নিধ্য—সব মিলিয়ে মানব ইতিহাস আসলে এক দীর্ঘ মিলন–গল্প।
অবশেষে বলা যায়—চুম্বন কেবল প্রেমের রূপক নয়; এটি প্রাণীজগত থেকে উত্তরাধিকার পাওয়া এক আচরণ। মানুষ যখন নিয়ান্ডারথালের মতো কাছের প্রজাতির সাথে মুখোমুখি হতো, তখন শুধুই অস্তিত্ব বা যুদ্ধ নয়—এতে ছিল ঘনিষ্ঠতা, যত্ন আর স্পর্শেরও গল্প। চুম্বন সেই গল্পেরই এক সূক্ষ্ম, নরম অংশ। যা কোটি বছর আগে জন্ম নিয়েও আজও সম্পূর্ণ অটুট।
আপনার মতামত জানানঃ