৩২ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ—সংখ্যাটি শুনতে স্বস্তির, কারণ দীর্ঘ সময় ধরে নাটকীয় পতনের পর আবার ওঠার ইঙ্গিত মিলেছে। কিন্তু অর্থনীতির আসল প্রশ্ন হলো, এই রিজার্ভ বৃদ্ধির বিনিময়ে আমরা কী পেলাম এবং সাধারণ মানুষের জীবনে তার প্রতিফলন কতটা দৃশ্যমান। মিলটন ফ্রিডম্যানের ‘গিটার স্ট্রিং’ তত্ত্বে যেমন বলা হয়, গভীর মন্দার পর অর্থনীতি দ্রুত ফিরে আসে আগের অবস্থায়, তেমন একটি স্থিতিস্থাপকতা যদি সত্যিই কাজ করত, তাহলে রিজার্ভের উন্নতি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও আয়ের প্রবাহে দ্রুত স্ফূরণ তৈরি করত। বাস্তবতা হলো, ২০২০–এর ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে আমাদের তারটি শুধু টানা হয়নি, মাঝেমধ্যে ছিঁড়েছেও—কোথাও নীতিগত অস্থিরতা, কোথাও কাঠামোগত অসুস্থতা, কোথাও আবার আস্থার খরায় অর্থনীতি শুকিয়ে গেছে। তাই ৩২ বিলিয়ন ডলার মজুদ দেখে খুশি হওয়া যায়, কিন্তু একইসঙ্গে হিসাব করতে হয় এই সঞ্চয়ের সুযোগব্যয়—কোন কোন জায়গায় আমরা ব্যয়সংযম, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ স্থগিত আর নীতিগত কড়াকড়ির মাধ্যমে অর্থনীতিকে ‘বেঁধে’ রেখেছি এবং তার ফলস্বরূপ কতখানি গতি হারিয়েছি।
রিজার্ভ বেড়েছে প্রধানত তিন কারণে—প্রবাসী আয়ের উল্লম্ফন, রপ্তানিতে তুলনামূলক উন্নতি এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণ। বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করার চেষ্টা, ডলারের লেনদেনে ভারসাম্য আনার উদ্যোগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিগত সংকেতে একধরনের স্থিতিশীলতা এসেছে। ডলারের চাহিদা কম ছিল, কারণ বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে এবং ভোগের বড় বড় সিদ্ধান্ত—যেমন যন্ত্রপাতি আমদানি, বৃহৎ প্রকল্পে নতুন চুক্তি, কাঁচামালের স্টকিং—সবকিছুতেই ব্যবসায়ীরা অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল। এতে রিজার্ভে ‘নেট ইনফ্লো’ পজিটিভ হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনতে পেরেছে। সংখ্যার খাতা তাই সবুজ দেখাচ্ছে। কিন্তু এই সবুজ রঙের আড়ালে যে ধূসরতা আছে, সেটি হলো বিনিয়োগের স্থবিরতা, ব্যক্তিখাতের ঋণপ্রবাহের দুর্বলতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয়ের ক্ষয়, এবং কর্মসংস্থানের সংকোচন। বেসরকারি ঋণপ্রবৃদ্ধি সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র ৬.৩৮ শতাংশে নেমে এসেছে—যে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন বেসরকারি খাত, সেখানে এই হার দিয়ে সামনের চাকা ঘোরানো কঠিন। নতুন কারখানা, নতুন প্রযুক্তি, নতুন শিফট—সবকিছুই ক্রেডিটের অক্সিজেন চায়; সেই অক্সিজেন কমে গেলে চাকরি বাড়ে না, মজুরি বাড়লেও জীবিকার খরচের সঙ্গে তাল মেলায় না।
তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পণ্যমূল্যস্ফীতির দীর্ঘস্থায়ী চাপ। মজুরি বৃদ্ধি হলেও তা মূল্যস্ফীতির চেয়ে পিছিয়ে, ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমছে। ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক ইতোমধ্যে চাকরি হারিয়েছেন—এই নগ্ন পরিসংখ্যানটি শুধু উৎপাদনশীলতার পতন নয়, সমগ্র চাহিদা-পক্ষের সংকোচনের ইঙ্গিত দেয়। যে পরিবারগুলো গত মাসেও ‘ডিসক্রিশনারি’ খরচ—বিনোদন, উন্নত পুষ্টি, ছোটখাটো ঘর মেরামত—করত, তারা এখন ‘এসেনশিয়াল’ খরচেও কাটছাঁট করছে। এই আচরণগত পরিবর্তন শুধু বাজারের লেনদেন কমায় না, বরং ব্যবসায়ীদের ভবিষ্যৎ প্রত্যাশাকেও নেতিবাচক সংকেতে ভরিয়ে দেয়, ফলে তারা আরও বিনিয়োগ স্থগিত রাখে। এই নীতিগত ও আচরণগত ‘ফিডব্যাক লুপ’ ভাঙা না গেলে রিজার্ভ বাড়লেও অর্থনীতির গতি ফেরানো কঠিন।
দারিদ্র্য নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি ছবির মধ্যে ব্যবধান উদ্বেগ বাড়ায়। বিবিএসের ২০২২ সালের জরিপে দারিদ্র্য ছিল ১৮.৭ শতাংশ; নতুন কোনো সরকারি পরিমাপ হয়নি। বিপরীতে পিপিআরসির গবেষণা বলছে, দারিদ্র্য এখন প্রায় ২৮ শতাংশ, আর ১৮ শতাংশ মানুষ ‘নন-পুওর বাট ভলনারেবল’—যারা সামান্য ধাক্কাতেই দরিদ্রসীমার নিচে নেমে যেতে পারেন। অর্থাৎ, নীতিনির্ধারণের জন্য যে সাম্প্রতিক মাপঝোক দরকার, সেটি অনুপস্থিত; পলিসি ব্লাইন্ডস্পট তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় ‘রিজার্ভ বেড়েছে’ খবরটি প্রান্তিক মানুষের কাছে কাগুজে। তারা জানতে চায় চালের দাম কমবে কবে, ভাড়া স্থিতিশীল হবে কীভাবে, চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কোন পদক্ষেপ আসছে, বিদ্যুৎ–জ্বালানির খরচে কি পূর্বানুমানযোগ্যতা আসবে। ম্যাক্রো–স্থিতিশীলতার সুফল মাইক্রো–জীবনে না পৌঁছালে আস্থা ফেরে না, আর আস্থা না ফিরলে বিনিয়োগ জাগে না—নীতির এই মৌলিক সত্য আবারও প্রমাণিত হচ্ছে।
আরেকটি বড় প্রশ্ন হলো অনিশ্চয়তা। নিকোলাস ব্লুমের অনিশ্চয়তা–বিষয়ক গবেষণা দেখায়, নীতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়–সন্দেহ বাড়লে প্রতিষ্ঠানগুলো ‘ওয়েট–অ্যান্ড–সি’ মুডে চলে যায়—নতুন বিনিয়োগ স্থগিত থাকে, বড় কেনাকাটা থেমে যায়, নিয়োগ কমে, ব্যাংক ঝুঁকি–প্রিমিয়াম বাড়ায়। আমাদের প্রেক্ষিতে অনিশ্চয়তার উৎসগুলো স্পষ্ট—আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আতঙ্ক, মব–সহিংসতার ঘটনা, চাঁদাবাজির অব্যাহত চাপ, নির্বাচনী সময়রেখা ও ফলাফলের ধোঁয়াশা, এবং অতীতের নীতিগত পালাবদলের স্মৃতি। যখন ব্যবসায়ী বোর্ডরুমে আলোচনা হয়, তারা শুধু আজকের সুদের হার বা আজকের ডলারের দাম দেখে সিদ্ধান্ত নেয় না; তারা দেখে ১২–১৮ মাসের নীতিগত ধারাবাহিকতার প্রতিশ্রুতি, চুক্তি–বাস্তবায়নের সক্ষমতা, আদালত ও নিয়ন্ত্রকের পূর্বানুমানযোগ্যতা, কর–নীতি স্থিতিশীলতা। এখানেই আমাদের ঘাটতি সবচেয়ে প্রকট। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল প্রাথমিক আস্থা পুনর্গঠন—চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলায় দ্রুত উন্নতি, নির্বাচনী রোডম্যাপের স্বচ্ছতা—কিন্তু বাস্তবে পিছলানি আছে। ফল হয়েছে এমন যে, আন্তর্জাতিক ক্রেতা অর্ডার বাড়াতে দ্বিধায়, দেশীয় উদ্যোক্তা মেশিন আমদানির সিদ্ধান্ত ঠেলে দিচ্ছেন, ব্যাংক গ্যারান্টির খরচ বাড়ছে।
তাহলে ৩২ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ কি ‘ভুল’ অর্জন? মোটেও না। রিজার্ভ হলো অর্থনীতির হার্টবিট—বাহ্যিক ধাক্কায় টিকে থাকার বাফার। আমদানি কভারেজ, রেটিং–এজেন্সির দৃষ্টিভঙ্গি, বৈদেশিক ঋণের পুনঃঅর্থায়ন, সাপ্লায়ারস’ ক্রেডিট—সবক্ষেত্রে রিজার্ভের সাইজ ও গুণমান গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমস্যাটি ‘রিজার্ভ আছে, তাই সব ঠিক’—এই আত্মতুষ্ট ধারণা। রিজার্ভ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাঁচটি খাতের ‘ট্রান্সমিশন’ একসঙ্গে কাজ না করলে সিস্টেম–ওয়াইড রিকভারি আসে না। প্রথমত, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা: খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিলের অপব্যবহার, অডিট ও গভর্ন্যান্স গ্যাপ—এসব না সামলালে ক্রেডিট চ্যানেল জ্যামই থাকবে। দ্বিতীয়ত, জ্বালানি–বিদ্যুৎ: লোড ম্যানেজমেন্ট ও ট্যারিফ পূর্বানুমানযোগ্য না হলে শিল্প পরিকল্পনা হয় না, ক্যাপেক্স থমকে যায়। তৃতীয়ত, বাণিজ্য–লজিস্টিকস: ক্লিয়ারেন্স টাইম, পোর্ট–রেল–রোড কানেক্টিভিটি, স্ক্যানার–কাস্টমসের গতি—এখানে মিলিমিটার–স্তরের উন্নতিও ব্যবসার ঘণ্টা–দিন সাশ্রয় করে, মার্জিনে পার্থক্য আনে। চতুর্থত, নীতি ধারাবাহিকতা: ভ্যাট–আয়কর–শুল্কে ‘মিড–ইয়ার’ টুইগ নয়, তিন বছরের রোলিং রোডম্যাপ দরকার। পঞ্চমত, আইনশৃঙ্খলা ও চুক্তি প্রয়োগ: ব্যবসায়ীর জন্য সবচেয়ে বড় ‘সাবসিডি’ হলো নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার—এটি বিনা ব্যয়ে বিনিয়োগ বাড়ায়।
বর্তমানে রপ্তানি পরপর দুই মাস কমেছে—গ্লোবাল ডিমান্ড, ইউনিট ভ্যালু, সাপ্লাই–চেইন শিফট, কমপ্লায়েন্স কস্ট, কার্বন–বর্ডার ট্যাক্সের আশঙ্কা—সব মিলিয়ে চাপ। আমদানি কিছুটা বাড়ায় ডলারে চাপও বাড়ছে, ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে রেট স্টেবল রাখতে চেয়েছে। এই সূক্ষ্ম ব্যালান্সিং–অ্যাক্টে যদি যোগাযোগের স্বচ্ছতা না থাকে—বাজারকে আগেভাগে সংকেত না দেওয়া হয়—তাহলে জল্পনা বাড়ে, আংশিক ডলারাইজেশনের আচরণ দেখা দেয়, যা আবার রিজার্ভ–ব্যবস্থাপনাকে জটিল করে। তাই মুদ্রানীতি, রিজার্ভ–ম্যানেজমেন্ট ও বিনিময়হারের ‘কমিউনিকেশন স্ট্র্যাটেজি’ হওয়া উচিত ডেটা–ড্রাইভেন, ক্যালেন্ডারভিত্তিক এবং স্বচ্ছ। বাজার বুঝতে চায় আপনি কী করবেন তা–ই নয়, কেন করবেন সেটিও।
মানুষের জীবনে রিজার্ভ–উন্নতির প্রতিফলন আনার সবচেয়ে দ্রুত তিনটি পথ আছে। এক, লক্ষ্যভিত্তিক মূল্যস্ফীতি–কমানো: ফুড ইনফ্লেশন টার্গেটে সরকার–বিবি–মন্ত্রণালয়গুলোর যৌথ টাস্কফোর্স, আমদানি–বাণিজ্যে অপ্রয়োজনীয় ‘ঘর্ষণ খরচ’ কমানো, কৃষিপণ্যে কোল্ড–চেইন ও লজিস্টিকসের মাইক্রো–হস্তক্ষেপ। দুই, কর্মসংস্থানে ত্বরান্বিত প্রণোদনা: এসএমই ও এক্সপোর্টারদের জন্য সাশ্রয়ী ও সময়বন্ধুত্বপূর্ণ ওয়ার্কিং–ক্যাপিটাল স্কিম, কিন্তু ‘স্মার্ট কন্ডিশনালিটি’সহ—ট্যাক্স ফাইল আপডেট, ই–ইনভয়েস, ডিজিটাল পেমেন্ট গ্রহণ বাধ্যতামূলক। তাতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ে, ভ্যাট–বেস চওড়া হয়, এবং ‘গুড বিহেভিয়ার’ উৎসাহ পায়। তিন, আস্থার রাজনীতি: আইনশৃঙ্খলায় জিরো–টলারেন্সের উদাহরণ, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ‘ফাস্ট–ট্র্যাক’ বিচার, নির্বাচনী ক্যালেন্ডার ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার দৃশ্যমান নিশ্চয়তা—এই প্রতীকী কাজগুলো বাজারে ‘অ্যাংকার’ বসায়।
একই সাথে ডেটা–গভর্ন্যান্সে ফাঁক ভরাট জরুরি। ২০২২–এর খানা আয়–ব্যয় জরিপ দিয়ে ২০২৫–এর নীতি চালানো যায় না। আপডেটেড পভার্টি প্যানেল, শ্রমবাজারের রিয়েল–টাইম ইনডিকেটর—ই–পিএফ, মোবাইল মানি লেনদেন, ইউটিলিটি ডিফল্ট রেট—এই ‘হাই–ফ্রিকোয়েন্সি’ ডেটা সরকার–বেসরকারি–একাডেমিয়া–ডেভেলপমেন্ট পার্টনারদের সঙ্গে উন্মুক্তভাবে ভাগ করা দরকার। এতে নীতি প্রতিক্রিয়া হবে দ্রুত, লক্ষ্যভেদী এবং জবাবদিহিমূলক। উদাহরণ হিসেবে, খাদ্যপণ্যে ‘টার্গেটেড ট্যারিফ অ্যাডজাস্টমেন্ট’ নিলে প্রতি পাক্ষিকে ডেটা রিভিউ করে নীতির সূক্ষ্ম পরিবর্তন করা যাবে—একে বলে ‘নাও–কাস্টিং’ পলিসি।
রেমিট্যান্সের উত্থান এই পর্বে আমাদের বড় ভরসা। কিন্তু হুন্ডির বিরুদ্ধে কেবল ‘কঠোরতা’ নয়, আরও তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ—বিদেশে নতুন শ্রমবাজার, স্কিল–আপগ্রেড ও সেফ মাইগ্রেশন; প্রবাসীদের জন্য ‘ভ্যালু–অ্যাডেড’ ব্যাংকিং প্রোডাক্ট—ডলার–বন্ড, প্রবাসী সঞ্চয়পত্র, নমনীয় মেয়াদি আমানত; এবং দেশে রিসিভ–সাইডের ঘর্ষণ কমানো—ফি, কিউ, কেওয়াইসি জটিলতা। প্রবাসীরা যদি দেখে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা পাঠালে তাদের পরিবার তাৎক্ষণিক ও কম খরচে পায়, এবং তারা নিজেরাও যে কোনো সময় সেই টাকায় বিনিয়োগ করতে পারে—হোক তা প্লট, বন্ড বা স্টার্টআপ—তাহলে ‘স্টিকিনেস’ বাড়ে। এই স্টিকিনেস রিজার্ভকে আরও ‘কোয়ালিটি রিজার্ভ’ বানায়।
এখন প্রশ্নের কেন্দ্রে ফিরি—৩২ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আমরা কী পেলাম। পেয়েছি স্বল্পমেয়াদি স্থিতি, বাহ্যিক খাতের ধাক্কা সামলানোর সক্ষমতা এবং বাজারকে ন্যূনতম স্বস্তির বার্তা। পাইনি যেটা, সেটি হলো ব্যাপকভিত্তিক পুনরুদ্ধারের প্রাণ—উদ্যমী বিনিয়োগ, সক্ষম চাকরি, বাস্তব আয়ের নিশ্চয়তা এবং অনিশ্চয়তা–মুক্ত একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ। এই ‘মিসিং লিঙ্ক’ পূরণ করতে হবে নীতির চারটি ‘সি’ দিয়ে—কনসিস্টেন্সি, ক্রেডিবিলিটি, ক্ল্যারিটি ও কোঅর্ডিনেশন। মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি যদি একে–অপরের বিপরীতে দাঁড়ায়, ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ যদি ‘সিগন্যাল’ না দিয়ে ‘সারপ্রাইজ’ দেয়, বাণিজ্যনীতি যদি এক সকালে হঠাৎ উল্টে যায়, তাহলে রিজার্ভের পাহাড় থেকেও বিনিয়োগের নদী নামবে না। বিপরীতে, মধ্যমেয়াদি একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ—খেলাপি ঋণ–কাটছাঁটের সময়সূচি, জ্বালানি ট্যারিফের সূত্র, কর–রিপর্মের ধাপ, কাস্টমস–ক্লিয়ারিং–টাইমের লক্ষ্য, আইনশৃঙ্খলা–পারফরম্যান্স মেট্রিক—যদি খোলা করে দেওয়া যায়, বাজার নিজেই ‘মাল্টিপ্লায়ার’ কাজ করবে।
গিটার স্ট্রিং থিওরি হয়তো বলবে, ধাক্কা সরে গেলে তারটি নিজে থেকেই ফিরে আসবে। কিন্তু আমাদের তারের টেনশন শুধু একদিকে নয়—কখনো নীতি–অস্পষ্টতায়, কখনো দুর্বল প্রতিষ্ঠান–ক্ষমতায়, কখনো অনিশ্চয়তার বোঝায়—বহুমুখে টান পড়ে। ফলে শুধু হাত ছেড়ে দিলেই হবে না, লাগবে ‘রিসেট’—সুর ঠিক করা, নাট ঠিক করা, পুরোনো মরচে ধরা ফ্রেট পাল্টানো। অর্থনীতির ভাষায় এর মানে হলো, স্বচ্ছ নির্বাচন দিয়ে আস্থার পুনর্গঠন, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে নিদর্শন–সৃষ্টিকারী ব্যবস্থা, ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত গভর্ন্যান্স, জ্বালানি–বিদ্যুৎ–লজিস্টিকসে পূর্বানুমানযোগ্যতা, এবং ডেটা–চালিত দ্রুত নীতিপরিবর্তনের সক্ষমতা। তখনই ৩২ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ শুধু ‘স্টক’ নয়, ‘ফ্লো’র ইন্ধন হবে—কারখানার নতুন শিফট চালু হবে, তরুণরা চাকরি পাবে, মজুরির বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে হার মানাবে, আর মানুষ বুঝতে পারবে সঞ্চয়ের পাহাড় ঘরে চালের হাঁড়ি ভরতে সাহায্য করছে।
আপনার মতামত জানানঃ