
গাজা এখন শুধু যুদ্ধের শেষে নেওয়া কোনো শান্তির চুক্তির অপেক্ষায় নয়—এখানে একটি নতুন, আরও গোপনসার এবং সংকটময় লড়াই শুরু হয়েছে। ক্ষতবিক্ষত উপত্যকায় কমছিলেনা আগুনের প্রতিধ্বনি; কিন্তু যুদ্ধবিরতির ধবধবে কাগজে যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হল, তাতে বাস্তবে কেউই নিঃশ্বাস খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ যুদ্ধের আরেকটি ভাঁজ খুলে দিয়েছে—গাজার ভেতরে ক্ষমতার জন্য ঘন ঘন সংঘর্ষ, যেখানে প্রতিটি অস্তিত্বহীন সরকারি কাঠামো আর বেসামরিক নিরাপত্তা ভেঙে পড়েছে, আর শূন্যস্থলকে পূরণ করতে ছুটছে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী, গোত্রীয় নেতারা এবং রাজনৈতিক ফ্র্যাকশন।
হামাস যুদ্ধের মধ্যে যেমন প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে, তেমনি তাদের অনেকে প্রাণ-দৈর্ঘ্য হারিয়েছেন; তাও তাদের রাজনৈতিক আবেগ, সামাজিক নিস্তরঙ্গতা ও ভূখণ্ডভিত্তিক নেটওয়ার্ক সহজে মিলিয়ে যায়নি। কিন্তু সংখ্যায় হেরলেও মনোবল ধরে রাখতে সক্ষম হওয়া এক ধরণের সংগঠনকে যুদ্ধের পরশে হারানো সহজ নয়—আর হামাস সে জায়গা রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিে তারা নিজেদের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য যে শক্তি প্রয়োগ করছে, তা নানামুখী: জঙ্গি ক্ল্যানদের বিরুদ্ধে রাকোট আক্রমণ, সন্দেহভাজন “সহযোগী” দেশি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি ও জনসমক্ষে দৃশ্যমান ছক কষা—সবই এক ধরনের বার্তা বহন করে যে তারা গাজার একমাত্র অস্বিকৃত শাসক ও প্রশাসনিক শক্তি রয়ে যেতে চায়।
দ্বিতীয় ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা গোষ্ঠীগুলো—ডগমুশ, আবু শাবাব, আল-মাজাইদা প্রভৃতি—শুধু অর্থ বা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণই চান না; তাদের লক্ষ্য রাজনৈতিক প্রভাব, তহবিলের অ্যাক্সেস ও সামাজিক ছোটখাটো আধিপত্য। বহু ক্ষেত্রে এই গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েল বা বিদেশি ত্বরকিত মাশরাফির সহায়তাও পেয়েছে; তাদের কেউ কেউ সরাসরি অভিযুক্ত হয়েছেন ত্রাণ লুট, সহযোগিতা বা কালোবাজারে ত্রাণ বিক্রির মতো কর্মকাণ্ডে। এসব অভিযোগ ও বাস্তবতার জটিল মিশ্রণ গাজাকে একটি অস্থির কূটকৌশলীয় স্তরে নিয়ে গেছে—যেখানে বাইরের শক্তি ও ভেতরের ক্ল্যানশক্তি একে অপরকে ব্যবহার করে ক্ষমতার খালা তৈরি করছে।
গাজার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়দের মধ্যে ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে)–ও রয়েছে। পিআইজে, মৌলিকভাবে একটি সশস্ত্র সংগঠন হিসেবেই পরিচিত, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য, লেবেল অনুযায়ী সংগঠিত শৃঙ্খলা, এবং দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক পৃষ্ঠপোষকতা—বিশেষ করে ইরানের সমর্থন—তাকে একটি বিশেষ অবস্থানে বসিয়েছে। পিআইজে যদি সঠিকভাবে শক্তি সংগ্রহ করে, সেটি হামাসের এক ধরনের রূপান্তরবাদী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গাজার অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য পাল্টানোর সম্ভাবনা রাখে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যুদ্ধের পরবর্তী বাস্তবে পিআইজে যদি সক্রিয় ভূমিকা নিয়তে পারে, তাহলে গাজার রাজনীতিতে একটি নতুন ধরনের পরিমণ্ডল তৈরি হবে—কখনও একে সহনশীল সমন্বয় বলা যাবে, আবার কখনও তা সংবিধানভিত্তিক কোনো স্থিতিশীলতা হিসেবে বিবেচনা করা কঠিন হবে।
এ সব কিছুর মাঝেই সবচেয়ে ভীতিকর চিত্রটি প্রকাশ পায় সাধারণ মানুষের জীবনে। ধ্বংসস্তূপের মাঝে ফেরার পথে হাজারো পরিবার মানবিক বিপর্যয়ের সঙ্গে লড়ছে—ভোজন ও ঘরের অভাব, স্বাস্থ্যসেবা-সংকট এবং ঘন ঘন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে তাদের প্রতিদিনের জীবন মিশে গেছে অকল্পনীয় কষ্টে। বাইরের সাইটগুলোর রিপোর্টগুলো বলছে, যুদ্ধের পর গাজায় মৃত ও আহতের সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে; বহু শহর ও গাঁও একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত, এবং অবকাঠামো–হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, পানিসহ—সবই ভেঙে পড়েছে। এই পরিস্থিতি সামলাতে স্থানীয় প্রশাসন বাস্তবিকভাবে অক্ষম, ফলে ক্ষুধা, অসুস্থতা ও অনিশ্চয়তার ভাঁটা বাড়ছে প্রতিটি দিন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন—যদি এই পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রিত না করা হয়, তাহলে গাজায় কেবল দুটি স্বতন্ত্র ঝুঁকি জমা হবে: এক, গৃহযুদ্ধের অভ্যন্তরীণ সম্ভাবনা, যেখানে ক্ল্যান-ভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক মিলিশিয়ারা পরস্পর মুখোমুখি হয়ে বসে; দুই, বহিরাগত শক্তির কৌশলগত হস্তক্ষেপ, যা স্থানীয় বিভক্তিকে নিজের সুবিধাজনক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার বানাবে। ইতোমধ্যেই এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে—কয়েকটি গোষ্ঠী ইসরায়েলের থেকে প্রতিকূল শক্তি হিসাবে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সুবিধা পেয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে, এবং এর প্রভাব ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা স্থিতি আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।
হামাসের দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি একটি জটিল সিদ্ধান্ত: তারা কি পুরোপুরি অস্ত্র ত্যাগ করে একটি প্রযুক্তিগত প্রশাসনে রূপান্তর হবে, নাকি সীমিত অস্ত্র রাখার যুক্তি দেখিয়ে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে? এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে অনেক কিছুর ওপর—আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ, আশপাশের শক্তিগুলোর কৌশল, এবং গাজার জনগণের সহনশীলতা। তবে বাস্তবতা হলো, হামাস এতই শক্তভাবে গাজার সাথে মিশে আছে যে একেবারে বিলুপ্ত হওয়া বা এককভাবে সব ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া দুটোই সহজ নয়। তাদের ভূমিকাই একদিকে গাজার সামাজিক আনুষঙ্গিক ক্ষমতাকে ধরে রেখেছে, অন্যদিকে আঞ্চলিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সংযোগগুলিকে একত্র করে রাখারও কাজ করছে।
গাজায় স্থিতিশীলতা কিভাবে আনা যাবে—এটি কোনো প্রযুক্তিবিদ্যা বা কেবল বিদেশি সংস্থার কাজ নয়; এটি রাজনৈতিক বৈঠক, অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈঠক, ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের সঙ্গে পুনর্গঠন কর্মসূচি এবং এক ধরনের ন্যায্য ক্ষমতার বন্টন ছাড়া সম্ভব নয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, কোনও বাহ্য দলকে সম্পূর্ণরূপে আমলে নিয়ে গাজার অভ্যন্তরীণ কাঠামো সারানোর পথ নেই; বরং স্থানীয় নেতাদের, ধর্মীয় ও সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোর সঙ্গে কাজ করে একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও পর্যায়ক্রমিক পুনর্গঠন পরিকল্পনা অপরিহার্য। তবেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রতিদিনের জীবন আর্তনাদ থেকে মুক্তি পাবে।
শেষ পর্যন্ত বাস্তবটি এই: গাজার আকাশে এখনো শকুন ঘুরে বেড়াচ্ছে—না শুধুই প্রতীকীভাবে, বরং বাস্তব রক্ত, ধ্বংস ও অনিশ্চয়তার আকারে। হামাস সহজে তাদের কর্তৃত্ব ছাড়বে না; গোত্রগুলো সুযোগ খুঁজছে; আর পিআইজের মতো সংগঠনগুলো তাদের নিজস্ব মুহূর্তের অপেক্ষায়। এই সংঘাতের মূল শিকার হবেন সাধারণ নাগরিকেরা। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও অঞ্চলের সব পক্ষকে এখন ন্যায্যতা, পুনর্গঠন এবং মানবিক সহায়তা প্রদানে সক্রিয় হতে হবে—না হলে গাজার ক্ষত আর গভীরতর হবে, আর শান্তি হবে কেবল এক দূরবর্তী কথা।
আপনার মতামত জানানঃ