মানব চোখের ক্ষমতা সীমিত। আমরা কেবল সূর্যের আলো থেকে নির্দিষ্ট রঙের রশ্মি দেখতে পারি, অর্থাৎ রঙিন দৃষ্টিসীমার ছোট অংশ। তবে প্রকৃতিতে বিদ্যমান প্রায় ৮০টি আলোক তরঙ্গ আমরা দেখতে পারি না। কিন্তু মানুষ মানসিকভাবে সীমাবদ্ধ নয়। প্রযুক্তি আমাদের সেই অদৃশ্য তরঙ্গ ধরার সুযোগ দেয়, যা চোখ বা জীবজগতের অন্য কোনো চোখ ধরা অসম্ভব।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) পৃথিবী থেকে প্রায় মিলিয়ন মাইল দূরে অবস্থান করছে। গত তিন বছর ধরে এটি আকাশে ইনফ্রারেড রশ্মি পরীক্ষা করছে, যা মানুষের চোখের দেখা লাল রঙের চেয়ে ৪০ গুণ দীর্ঘ। JWST থেকে আসা ছবি সাধারণ ছবি নয়, এটি ডেটার ব্যাখ্যা; বৈজ্ঞানিক সফটওয়্যার ও কল্পনার মাধ্যমে এগুলোকে আমাদের বোঝার মতো রূপ দেওয়া হয়।
JWST হলো মানব প্রযুক্তির শীর্ষায়ন। এটি আমাদের বিবর্তনগত অন্ধতা দূর করে, মানুষের দৃষ্টিকে সেই পর্যায়ে নিয়ে গেছে যেখানে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে সব দেখা সম্ভব। JWST-এর আয়নাগুলো ৬.৫ মিটার ব্যাসের, ১৮টি হেক্সাগোনাল সন্নিবেশিত আয়না দিয়ে তৈরি, বেধ কম এবং সোনার পাতার মাধ্যমে আচ্ছাদিত। এগুলো এক সেকেন্ডে লক্ষ কোটি আলো ধরে ফেলতে সক্ষম। সূর্যের আলো থেকে রক্ষার জন্য টেলিস্কোপটি ২১ মিটার বড় সূর্যছায়া পেছনে রেখে স্থির থাকে, যাতে তার অত্যন্ত সংবেদনশীল যন্ত্রাংশ তাপ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
এই সব আধুনিক প্রযুক্তি বহু শতাব্দী আগে উইলিয়াম হর্শেল-এর কাজের ওপর ভিত্তি করে। হর্শেল ১৭৮১ সালে ইউরেনাস গ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন, তবে তার আরও অনেক অবদান রয়েছে। তিনি পৃথিবীর বৃহত্তম টেলিস্কোপ তৈরি করেছিলেন, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মানচিত্র তৈরি করেছিলেন, এবং জীবনের অন্যান্য রূপ নিয়ে ভাবনা করেছিলেন। ১৮০০ সালে তিনি একটি পরীক্ষার মাধ্যমে এমন রশ্মি আবিষ্কার করেন, যা চোখে দেখা যায় না কিন্তু তাপ বহন করে। এই আবিষ্কারকে আমরা আজ ইনফ্রারেড রশ্মি বলি।
হর্শেল সূর্যের আলোকে প্রিজম দিয়ে ভেঙে বিভিন্ন রঙের তাপমাত্রা পরিমাপ করেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, লাল রঙের বাইরে এমন কিছু রশ্মি আছে যা চোখে দেখা যায় না কিন্তু তাপ অনুভূত হয়। তিনি এটিকে ‘রেডের বাইরে অদৃশ্য তাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই আবিষ্কার মানব দর্শনের সীমারেখা বিস্তৃত করে। হর্শেল দেখিয়েছিলেন, কিছু অংশের বাস্তবতা আমরা কেবল অনুভব করতে পারি না, কারণ তা আমাদের চোখের জন্য তৈরি নয়।
এরপরের শতাব্দীতে আরও গবেষকরা ইনফ্রারেড রশ্মি ধরার যন্ত্র তৈরি করেন। ১৮৫৬ সালে চার্লস পিয়াজ্জি স্মিথ চাঁদের ইনফ্রারেড রশ্মি পরিমাপ করেন। ১৯১০-এর দশকে রবার্ট উইলিয়ামস উড ইনফ্রারেড সেনসিটিভ ফিল্ম ব্যবহার করে পৃথিবীর দৃশ্য ধারণ করেন। ১৯৬৬ সালে গেরি নিউগেবাউর এবং এরিক বেকলিন মাউন্ট উইলসনের শীর্ষে প্রথমবার নক্ষত্র ও নবজাতক তারার ইনফ্রারেড আবিষ্কার করেন। এর ফলে আমরা এমন বস্তু দেখতে পাই যা দৃশ্যমান আলোতে অদৃশ্য।
তবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল অনেক ইনফ্রারেড রশ্মি শোষণ করে, তাই মহাকাশে পাঠানো প্রথম সত্যিকারের ইনফ্রারেড উপগ্রহ IRAS ১৯৮৩ সালে লঞ্চ করা হয়। মাত্র ১০ মাসে এটি ৩৫০,০০০ ইনফ্রারেড উৎস শনাক্ত করে, গ্যাস ও ধূলি ছায়াপথের ছবি ধরতে সক্ষম হয় এবং নবজাতক নক্ষত্র ও গ্রহের জন্মস্থল খুঁজে বের করে।
JWST হল IRAS-এর উন্নত সংস্করণ। এটি আরও দূরবর্তী মহাকাশে, এমনকি প্রথম গ্যালাক্সি গঠনের সময়কার আলো পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। আমাদের জানাযাচ্ছে, সবচেয়ে দূরবর্তী গ্যালাক্সি JADES-GS-z14-0, যা আমাদের নিকটবর্তী নয়, বরং ১৩.৪ বিলিয়ন বছর পূর্বের। JWST-এর ডেটা আমাদের বুঝতে সাহায্য করছে তারার গঠন, গ্যালাক্সির রঙ, তরঙ্গ এবং উত্স।
ফিলোসফাররা ১৯৯৮ সালে বলেছিলেন, মানুষের চিন্তাধারা মাথার ভিতরেই সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের প্রযুক্তি ও পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় আমাদের বোধ আরও প্রসারিত হয়। JWST-এর ইনফ্রারেড ডেটা আমাদের কল্পনা ও জ্ঞানকে সম্প্রসারিত করছে। আমরা এখন কেবল পর্যবেক্ষক নয়, প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে মহাকাশের অংশ হয়ে উঠেছি।
অতএব, হর্শেল থেকে শুরু করে IRAS এবং JWST পর্যন্ত সমস্ত আবিষ্কার আমাদের চোখের সীমা ছাড়িয়ে অদৃশ্য মহাবিশ্বে প্রবেশের ইতিহাস। প্রতিটি নতুন আবিষ্কার নতুন দৃষ্টিকোণ এবং বাস্তবতার স্তর আমাদের সামনে তুলে ধরে। আমরা বুঝতে পারি, মানুষ কেবল যা দেখতে সক্ষম, সেটিই নয়, প্রযুক্তি আমাদের দৃষ্টির পরিধি বৃদ্ধি করে মহাবিশ্বের সঙ্গে আরও গভীরভাবে যুক্ত করে।
আপনার মতামত জানানঃ