আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি। স্বাধীনতার নেতৃত্ব থেকে শুরু করে বিগত দেড় দশক ধরে টানা ক্ষমতায় থাকা—সব মিলিয়ে এ দলটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। তবে ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন, পরবর্তী গণঅভ্যুত্থান এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আবির্ভাব আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। দলটি এখন নিষিদ্ধ, অনেক শীর্ষ নেতা জেলে বা নির্বাসনে, আর হাজার হাজার কর্মী নানাভাবে হয়রানির শিকার। এই পটভূমিতেই কলকাতা হয়ে আবার রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ ও চিকিৎসক হাবিবে মিল্লাত এর একটি প্রতিচ্ছবি। তিনি স্মরণ করেন, কীভাবে ঢাকায় কয়েক সপ্তাহ গোপনে থাকার পর অবশেষে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কলকাতায় এসে পৌঁছতে হয়েছিল। গাড়ি, মোটরসাইকেল, এমনকি পায়ে হেঁটে ২২ ঘণ্টার এক দুরূহ যাত্রা শেষে তিনি পৌঁছান কলকাতায়। এখন সেখানেই স্ত্রীসহ ভাড়া করা এক অ্যাপার্টমেন্টে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। তিনি বলছেন, এ যাত্রা কেবল ব্যক্তিগত বেঁচে থাকার জন্য নয়, বরং আওয়ামী লীগকে আবার সংগঠিত করার লড়াইয়ের অংশ। তার দাবি, অন্তত ৬৩৭টি ঘটনায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা জনতার হাতে প্রহৃত হয়েছেন এবং ১১৬ জন সাবেক এমপি এখনো জেলে আছেন।
কলকাতায় নির্বাসিত আওয়ামী লীগ নেতাদের অবস্থান নিয়েও নানা আলোচনা। অনেকে বলছেন, সেখানে দলটি গোপনে একটি অফিস খুলেছে। যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা সরাসরি তা অস্বীকার করছেন। তাদের বক্তব্য, কয়েকজন একসঙ্গে বসলে তাকে অফিস বলা যায় না। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, কলকাতার একটি মলের কফিশপে মাঝে মধ্যে তারা বসেন, এটাকে অফিস বলা অতিরঞ্জন ছাড়া কিছু নয়। তবে বাস্তবতা হলো, তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। সীমান্তের এপারের কর্মীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করছেন, আবার দিল্লিতে গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। লক্ষ্য একটাই—২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগেই দেশে ফেরা এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়া।
কলকাতা আওয়ামী লীগের কাছে নতুন নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় দলটি এখান থেকেই অস্থায়ী সরকার চালিয়েছিল। তখন ভারত ছিল সবচেয়ে বড় মিত্র। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের প্রতি জনমতের পরিবর্তন হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ভারত বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায়। ফলে কলকাতা থেকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পরিচালনা করলে জনগণের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হতে পারে। হাবিবে মিল্লাতও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তার ভাষায়, “অনেক মানুষ মনে করে ভারত আমাদের নিজেদের একটি রাজ্য মনে করে। তাই খুব সাবধানে খেলতে হয়।”
আওয়ামী লীগের কর্মীদের দৈনন্দিন জীবনও বদলে গেছে। একসময় যারা ক্ষমতার চূড়ায় ছিলেন, তারা এখন কলকাতায় সাধারণ জীবনযাপন করছেন। ব্যাংকের লাইনে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালার সঙ্গে দর কষাকষি—সবই তাদের নতুন বাস্তবতা। তবুও দলের প্রতি আনুগত্যে ভাটা পড়েনি। সাবেক ছাত্রনেতা সাদ্দাম হোসেন কলকাতার নিউ টাউনে অবস্থান করে প্রতিদিন বাংলাদেশের ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তার ভাষায়, “মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে, প্রতিদিনের আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ইউনূস সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।”
অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো আওয়ামী লীগের ফিরে আসার সম্ভাবনা একেবারেই নাকচ করে দিয়েছে। বিএনপি এবং নতুন গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি সরাসরি বলছে, আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিস্ট দল এবং তাদের রাজনীতিতে ফেরার কোনো অধিকার নেই। বিএনপির রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির সারোয়ার তুষারের মতে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
ভারতের অবস্থানও জটিল। ঐতিহাসিকভাবে ভারত প্রায়ই আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকেছে, কারণ বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী আন্দোলনে জামায়াত বা বিএনপির নেতাদের প্রতি ভারতের সন্দেহ দীর্ঘদিনের। ফলে ভারত কৌশলগত স্বার্থে আওয়ামী লীগকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। তবে এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষক আদিত্য গোদারা শিবমূর্তির মতে, ভারত চাইলেও আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে পারবে না, আবার তাদের ফেরানোও সহজ নয়। কারণ এতে ভারতের প্রতি আস্থাশীল অন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিভ্রান্ত হবে। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পুনরুত্থান হলেও তা অনেক বছর সময় নেবে। ভারতের সামনে এখন বাস্তবতা হলো—বাংলাদেশে যে-ই ক্ষমতায় আসুক, দিল্লিকে তার সঙ্গেই কাজ করতে হবে।
এই অবস্থার মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতারা আত্মবিশ্বাস হারাতে রাজি নন। তাদের বিশ্বাস, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাওয়া গেলে সংগঠনের শক্তি ব্যবহার করে তারা উল্লেখযোগ্য ভোট পাবে। বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় তাদের দীর্ঘদিনের শিকড় ও সাংগঠনিক কাঠামো কাজে লাগবে। প্রশ্ন হলো, জনগণ যারা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে, তারা আবার কতটা আস্থা রাখবে সেই দলে?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পুনরুত্থান নতুন কিছু নয়। অতীতে যে দল ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, তারা নানা সময় ফের ক্ষমতায় এসেছে। তবে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ দ্বিগুণ। একদিকে আইনি নিষেধাজ্ঞা, অন্যদিকে জনতার ক্ষোভ। এর ওপর বিরোধী দলগুলোর প্রবল বিরোধিতা এবং ভারতের জটিল অবস্থান মিলিয়ে পথটি কঠিন। কলকাতা থেকে নির্বাসিত নেতাদের প্রচেষ্টা রাজনৈতিক প্রতীকী অর্থ বহন করলেও, তা কতটা বাস্তব পরিবর্তন আনতে পারবে, সেটাই বড় প্রশ্ন।
সব মিলিয়ে ছবিটা দাঁড়াচ্ছে এমন—আওয়ামী লীগ এখন সীমান্তের ওপার থেকে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। নির্বাসিত নেতা-কর্মীদের একাংশ আত্মবিশ্বাসী যে, তারা আবারো জনগণের সমর্থন পাবে। কিন্তু তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, আওয়ামী লীগ আর কোনোদিন নির্বাচনে ফিরতে পারবে না। ভারত তাদের ঐতিহাসিক মিত্র হলেও এখন দ্বিধাগ্রস্ত। আর বাংলাদেশের জনগণ? তারা এখনো আন্দোলনের জোয়ারে পরিবর্তনের স্বাদ নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন তাই অনিশ্চয়তায় ঘেরা এক দীর্ঘ যাত্রা। এই যাত্রার গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে অনেক, আর ততদিনে রাজনৈতিক বাস্তবতা হয়তো আবারও বদলে যাবে।
এই সমগ্র প্রক্রিয়া বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আওয়ামী লীগ কি সত্যিই কলকাতা থেকে ফিরে এসে আবার জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নিতে পারবে, নাকি নির্বাসিত নেতৃত্বের ভরসায় দলটি ধীরে ধীরে ইতিহাসের পাতায় মিলিয়ে যাবে—তা এখনো অমীমাংসিত প্রশ্ন। কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার—আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলেও, তার রাজনৈতিক ছায়া এখনো বাংলাদেশের অঙ্গনে গভীরভাবে বিদ্যমান।
আপনার মতামত জানানঃ