কাতারের দোহায় সাম্প্রতিক আরব-ইসলামিক সম্মেলনে মুসলিম দেশগুলোর যৌথ সামরিক বাহিনী গঠনের প্রস্তাব আবারও সামনে এসেছে। ইসরায়েল কর্তৃক কাতারে হামলার এক সপ্তাহের মধ্যেই এই সম্মেলনে ৫৫টিরও বেশি দেশের নেতা একত্রিত হন। মূল আলোচনার বিষয় ছিল গাজায় দুই বছর ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ, ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি। সম্মেলনে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি নেটোর আদলে একটি যৌথ আরব বাহিনী গঠনের প্রস্তাব রাখেন, যা আরব বিশ্বে আবারও “আরব নেটো” আলোচনার জন্ম দেয়।
এই প্রস্তাব নতুন নয়। ২০১৫ সালেও একই ধরনের প্রস্তাব তোলা হয়েছিল। সেসময় ইয়েমেন, লিবিয়া ও সিরিয়ায় ইসলামপন্থী সশস্ত্র গ্রুপের উত্থান ঠেকাতে একটি সমন্বিত আরব বাহিনী গঠনের কথা বলা হয়েছিল। তবে আরব লিগের ভেতরে একাধিক রাষ্ট্রের অনাগ্রহের কারণে উদ্যোগটি ভেস্তে যায়। এখন ২০২৫ সালে আবারও একই প্রস্তাব সামনে এসেছে, যার পেছনে রয়েছে গাজা যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন।
সম্ভাবনার দিক থেকে এই বাহিনী গঠন গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। যদি নেটোর আদলে কার্যকর করা যায়, তবে কোনো একটি আরব দেশ আক্রান্ত হলে তা সব দেশের ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং সবাই মিলে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলবে। এতে বিমান, নৌ ও স্থল বাহিনী অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। মিশর সদর দপ্তর কায়রোতে রাখার প্রস্তাব দিয়েছে, যা দেশটির ঐতিহাসিক সামরিক শক্তি ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রতিফলিত করে। সৌদি আরব, তুরস্ক এবং পাকিস্তানের মতো সামরিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোও যুক্ত হলে এটি একটি বড় জোটে পরিণত হতে পারে।
তবে বাস্তব প্রতিবন্ধকতা অস্বীকার করা যায় না। আরব বিশ্বের ইতিহাস বলছে, ঐক্যবদ্ধ সামরিক উদ্যোগ বারবার রাজনৈতিক মতপার্থক্যে ভেস্তে গেছে। ১৯৪৮ সালে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় মিশর, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাক মিলিত হয়ে যুদ্ধ করলেও নিজেদের ভেতরের দুর্বল সমন্বয় তাদের পরাজয়ের কারণ হয়। পরে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ এবং ১৯৭3 সালের ইয়োম কিপুর যুদ্ধও দেখিয়েছে আরবদের সম্মিলিত শক্তির অভাব। আরব লীগ শান্তিরক্ষা বাহিনী গঠন করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেনি।
গাল্ফ অঞ্চলের জিসিসি (গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল) অতীতে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছিল, কিন্তু সেটিও মূলত প্রতীকী রয়ে গেছে। কুয়েত আক্রমণের সময় ১৯৯০ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ করতে পারেনি, বরং যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোটকে এগিয়ে আসতে হয়। তাই ইতিহাস বলছে, আরব দেশগুলোর যৌথ সামরিক কাঠামো কাগজে অনেকবার আঁকা হলেও বাস্তবে সফল হয়নি।
বর্তমান সময়েও বিভাজন প্রবল। সৌদি আরব ও ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কাতার সংকট, তুরস্কের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার এবং মিশর-তুরস্ক সম্পর্কের টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর বাহিনী গঠন সহজ হবে না। তাছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থানও ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের ঘনিষ্ঠ, আবার কেউ রাশিয়া বা চীনের দিকে ঝুঁকছে। এই বহুমাত্রিক কূটনৈতিক অবস্থান সামরিক ঐক্যকে দুর্বল করে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এর প্রভাব বড়। যদি সত্যিই “আরব নেটো” বাস্তবায়িত হয়, তবে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তিত হবে। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, দীর্ঘদিন ধরে গাল্ফ অঞ্চলের নিরাপত্তায় প্রভাবশালী ভূমিকা রেখে এসেছে। একটি শক্তিশালী আরব বাহিনী সেই প্রভাব কমিয়ে দিতে পারে এবং ইসরায়েলের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। একইসঙ্গে এটি ফিলিস্তিনের প্রশ্নে মুসলিম দেশগুলোকে একক কণ্ঠ দেওয়ার চেষ্টা করবে।
তবে সমালোচকরা মনে করেন, এই উদ্যোগ মূলত প্রতীকী। সম্মেলনের যৌথ বিবৃতিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়ানোর কথা বলা হলেও বাস্তবিক সামরিক উদ্যোগে যেতে তারা কতটা প্রস্তুত, তা স্পষ্ট নয়। অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্য করেছেন, আগের মতো এবারও কেবল নিন্দা জ্ঞাপন আর কিছু কাগুজে প্রস্তাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ইয়েমেনি রাজনীতিবিদ শেখ হুসেন হাজেব যেমন বলেছেন, এই বাহিনী গঠনের “উত্থানের আগেই মৃত্যু” ঘটবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, মুসলিম বিশ্বের যৌথ সামরিক বাহিনী গঠনের ধারণা আবারও আলোচনায় এসেছে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতি ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক কার্যক্রম এ আলোচনাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তবে ইতিহাস, রাজনৈতিক বিভাজন ও ভিন্ন কূটনৈতিক স্বার্থের কারণে এর বাস্তবায়ন এখনো অনিশ্চিত। তবুও বারবার প্রস্তাব তোলা হচ্ছে বলেই বোঝা যায়, মুসলিম বিশ্বের মধ্যে অন্তত একটি অংশ এখনো ঐক্যবদ্ধ প্রতিরক্ষা কাঠামো গঠনের স্বপ্ন আঁকছে।
আপনার মতামত জানানঃ