যুক্তরাজ্যের লন্ডনে এক বাংলাদেশি মুসলিম যুবক বর্ণবাদী হামলার শিকার হয়েছেন। স্থানীয় সময় শুক্রবার হিথ্রো এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী যুবকের নাম ইফতি। তিনি তার মায়ের সঙ্গে বিমানবন্দর থেকে ফেরার পথে হামলার মুখে পড়েন।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, ইফতি তার মাকে নিয়ে খাবারের জন্য পথে একটি স্থানে থামেন। এ সময় কয়েকজন ব্যক্তি তার মায়ের বোরকা পরা নিয়ে অশালীন মন্তব্য করতে থাকে। ছেলে প্রতিবাদ করলে তাদের একজন হাতে থাকা বেসবল ব্যাট দিয়ে ইফতির মাথায় আঘাত করে এবং তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। হামলার সময় মুসলিমবিদ্বেষী গালাগালও করা হয়। স্থানীয়রা এগিয়ে এলে হামলাকারীরা দ্রুত পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে মা ও ছেলেকে হাসপাতালে নেয়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ইফতি বাসায় ফিরেছেন। বর্তমানে পুলিশ তদন্ত করছে।
ইসলামফোবিয়া এখন একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা। এটি মূলত মুসলমানদের প্রতি ভীতি, ঘৃণা ও বৈষম্যের একটি প্রবণতা, যা সমাজে সহাবস্থানের ধারণাকে নষ্ট করে দেয়। পশ্চিমা বিশ্বে অনেক মানুষ ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত চরমপন্থী কর্মকাণ্ডের খবর ইসলামকে সহিংসতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে। ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলা থেকে শুরু করে আইএস, আল-কায়েদা বা বোকো হারামের মতো সংগঠনের ভয়ঙ্কর কার্যকলাপ পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের প্রতি আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এই ভীতিকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগায় ডানপন্থী সংগঠনগুলো। তারা দাবি করে, ইসলাম পশ্চিমা সংস্কৃতির জন্য হুমকি। ফলে সাধারণ মানুষও অনেক সময় মুসলিমদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে।
তবে ইসলামফোবিয়ার জন্য শুধুই পশ্চিমা সমাজ বা রাজনৈতিক প্রচারণা দায়ী নয়। মুসলিম সমাজের কিছু অংশও এর জন্য দায়ী। যখন কোনো মুসলিম গোষ্ঠী ধর্মের নামে সহিংসতা চালায়, আত্মঘাতী হামলা করে বা নারীর স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে, তখন তারা বিশ্বের কাছে ইসলামের বিকৃত চিত্র তুলে ধরে। এমনকি প্রবাসী সমাজের মধ্যেও কেউ কেউ আইন না মেনে, গেটো সংস্কৃতি তৈরি করে, স্থানীয় সমাজের সঙ্গে মেলামেশা এড়িয়ে চলে। এর ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন ও অবিশ্বাস বাড়ে। অনেক সময় ছোটখাটো অপরাধ বা অসামাজিক আচরণও মুসলিম পরিচয়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়, যা ইসলামফোবিয়াকে আরও উস্কে দেয়।
এই দ্বিমুখী বাস্তবতার কারণে মুসলিমদের প্রতি ভয় ও ঘৃণার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। পশ্চিমা রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে ভোটের স্বার্থে অভিবাসী ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। অপরদিকে মুসলিম সমাজের ভেতরে থাকা চরমপন্থী ও অসহিষ্ণু অংশ ইসলামের প্রকৃত দয়া, শান্তি ও মানবিকতার বার্তাকে আড়াল করে দেয়। এতে সাধারণ শান্তিপ্রিয় মুসলিমরা অন্যায়ভাবে ভুক্তভোগী হয়ে পড়ে।
ইসলামফোবিয়ার ফলাফল মারাত্মক। প্রথমত, এটি ব্যক্তিকে সরাসরি ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়—যেমন ইফতির ওপর হামলা। দ্বিতীয়ত, মুসলিমরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক জীবনে বৈষম্যের শিকার হয়। তৃতীয়ত, প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুসলিম তরুণরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে, যা তাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। কখনো কখনো এই হতাশা উল্টো চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেয়, ফলে সমস্যাটি আরও ঘনীভূত হয়। সর্বশেষে, সমাজে সহাবস্থানের পরিবেশ নষ্ট হয়; বিভাজন, ঘৃণা ও হিংসা বেড়ে যায়।
অতএব, ইসলামফোবিয়া মোকাবিলায় একতরফা দোষারোপ যথেষ্ট নয়। পশ্চিমা সমাজকে যেমন মুসলিমদের প্রকৃত রূপ বুঝতে হবে এবং রাজনৈতিকভাবে ঘৃণা উসকে দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, তেমনি মুসলিম সমাজকেও নিজেদের ভেতরের সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হলো দয়া, সহমর্মিতা ও শান্তি—এটি নিজেদের আচরণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অবদান, এবং সামাজিক সহাবস্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে মুসলিমরা নেতিবাচক ধারণা ভাঙতে পারে।
লন্ডনের সাম্প্রতিক এই হামলা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ইসলামফোবিয়া শুধু একটি বৈষম্য নয়, এটি মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে। সমাজের প্রতিটি অংশকেই এই প্রবণতা মোকাবিলায় দায়িত্ব নিতে হবে। অন্যথায় ঘৃণা ও সহিংসতার এই চক্র ভাঙা সম্ভব হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ