ইসরায়েল নামটি আজ বিশ্বরাজনীতিতে এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের প্রতীক। মাত্র ৭৭ বছরের পুরোনো রাষ্ট্র, আয়তনে বাংলাদেশের অর্ধেকেরও কম, জনসংখ্যায় মধ্যপ্রাচ্যের বড় দেশগুলোর তুলনায় সামান্য—কিন্তু তার প্রভাব, শক্তি ও ভয়ঙ্কর উপস্থিতি পৃথিবীর কূটনীতিকে নাড়িয়ে দেয়। গাজায় হত্যাযজ্ঞ, পশ্চিম তীরে দখল, সিরিয়া-লেবাননে হামলা কিংবা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ—এসব সত্ত্বেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে খুব কম দেশই সাহস দেখায়। বরং দেখা যায়, নীরবতা, দ্বৈত মান অথবা অঘোষিত সমর্থন। প্রশ্ন জাগে: কেন? কেন একটি রাষ্ট্র এত ক্ষমতাশালী যে বিশ্বের অনেক দেশ তার বিরুদ্ধে যেতে ভয় পায়? কেন ফিলিস্তিনিদের রক্তক্ষয়ী কান্না, শিশুদের কঙ্কালসার দেহ কিংবা ধ্বংসস্তূপে মিশে যাওয়া শহরগুলো আন্তর্জাতিক আদালত বা জাতিসংঘকে নাড়া দিলেও বাস্তব পদক্ষেপ দেখা যায় না?
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও ভয়ের বীজ
১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের জন্ম হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাস্তবতায়। ইউরোপে ইহুদিদের উপর নাৎসি গণহত্যার ভয়াবহ স্মৃতি তখনো তাজা। সেই আবেগ, সেই অপরাধবোধ, সেই আন্তর্জাতিক সহানুভূতিই ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৈধতা এনে দেয়। আরব দেশগুলো তখনই এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধেই পরাজিত হয় মিশর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন। ছোট্ট নতুন রাষ্ট্রটি প্রমাণ করল—সে দুর্বল নয়, বরং আক্রমণ ঠেকাতে এবং পাল্টা আঘাত হানতে সক্ষম। এই প্রথম পরাজয় আরব বিশ্বে ভয় তৈরি করে দেয়।
এরপর আসে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ। মাত্র এক সপ্তাহে ইসরায়েল দখল করে নেয় সিনাই উপদ্বীপ, গোলান মালভূমি, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম। ভূখণ্ডের আয়তন প্রায় তিনগুণ হয়ে যায়। বিশ্ব তখন বুঝতে বাধ্য হয়, ইসরায়েল কেবল টিকে থাকার রাষ্ট্র নয়, বরং আক্রমণাত্মক শক্তি। যুদ্ধটি ইসরায়েলের “অপরাজেয় ভাবমূর্তি” তৈরি করে দেয়।
১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপুর যুদ্ধেও মিশর ও সিরিয়া হঠাৎ আক্রমণ চালিয়েছিল। শুরুতে তারা সাফল্য পেলেও অল্প সময়েই ইসরায়েল পাল্টা আঘাতে পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দেয়। ফলাফল—আবারও আরব বিশ্ব হতাশ ও ভীত। সেই থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ধীরে ধীরে সরাসরি যুদ্ধ থেকে সরে এসে আপস বা সমঝোতার পথ খোঁজে।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির অটল ছায়া
ইসরায়েলের শক্তি শুধু নিজের সামরিক দক্ষতায় সীমাবদ্ধ নয়। এর পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অদৃশ্য ছাতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকার রাজনৈতিক অভ্যন্তরে ইহুদি লবি সবসময় শক্তিশালী ছিল। কংগ্রেস থেকে হোয়াইট হাউস পর্যন্ত—ইসরায়েলের নিরাপত্তা মার্কিন রাজনীতির অন্যতম অনড় নীতি। ২০১৯ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর প্রায় ৩.৩ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। এ ছাড়া গোয়েন্দা সহযোগিতা, অস্ত্র উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি—সবকিছুতে রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
মার্কিন সমর্থনের কারণে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলবিরোধী প্রস্তাব বারবার ভেস্তে যায়। আমেরিকা বারবার ভেটো দেয়। ফলে আন্তর্জাতিক মহল জানে—ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে গেলেই যুক্তরাষ্ট্রকে সামনে দাঁড় করাতে হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে খোলামেলা বিরোধে যেতে অধিকাংশ দেশই সাহস করে না।
পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের রহস্যময় ভয়
ইসরায়েল কখনো প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও সবারই জানা—তাদের হাতে আছে পারমাণবিক অস্ত্র। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, দেশটির কাছে অন্তত ৯০ থেকে ৪০০ পর্যন্ত পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। এগুলো বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য। একে বলা হয় “পারমাণবিক ত্রিমাত্রিকতা” (triad)। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো তথাকথিত “স্যামসন অপশন”—যেখানে বলা হয়, ইসরায়েল যদি অস্তিত্বের সংকটে পড়ে, তবে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংস করে দেওয়ার মতো প্রতিশোধমূলক আঘাত হানবে। এই ঘোষণাবিহীন নীতি বিশ্বকে আরও সতর্ক করে রেখেছে। ফলে ইসরায়েলকে সামরিকভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে কেউ আগ্রহী হয় না।
অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি
আজকের ইসরায়েল শুধু সামরিক শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। দেশটি “স্টার্টআপ নেশন” নামে পরিচিত। টেল-আভিভ ও হাইফা হয়ে উঠেছে বিশ্বমানের প্রযুক্তি কেন্দ্র। সাইবার নিরাপত্তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ড্রোন প্রযুক্তি—এসব খাতে ইসরায়েল শীর্ষ পর্যায়ের উদ্ভাবন করছে। অনেক পশ্চিমা দেশ তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য ইসরায়েলের প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। এ নির্ভরতা দ্বন্দ্ব তৈরি করে: একদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা, অন্যদিকে প্রযুক্তিগত সহযোগিতার প্রয়োজন। ফলে ইসরায়েলকে বর্জন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
অর্থনৈতিক সূচকে দেশটির অবস্থানও শক্তিশালী। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ইসরায়েলের নামমাত্র GDP বিশ্বে ২৫তম এবং মাথাপিছু আয় ১৩তম। এই অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য তাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কূটনীতিতে এক প্রভাবশালী খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে।
ইতিহাসে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যাওয়ার পরিণতি
ইতিহাস বলছে, যারা ইসরায়েলকে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ করেছে, তাদের পরিণতি ভালো হয়নি।
সাদ্দাম হোসেন: ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে ইসরায়েলের দিকে স্কাড মিসাইল ছুড়েছিলেন। ফলাফল—মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ইরাকের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ চালায়। সাদ্দামের পতন ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।
মুয়াম্মার গাদ্দাফি: লিবিয়ার প্রাক্তন নেতা ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান এবং ফিলিস্তিনিদের সরব সমর্থক ছিলেন। পশ্চিমা বিশ্বের চোখে তিনি “অস্বস্তিকর মিত্র” হয়ে ওঠেন। ২০১১ সালে ন্যাটো হামলায় তার পতন ঘটে।
ইরান: আজও ইসরায়েলের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে ইরান টিকে আছে। তবে দেশটি ক্রমাগত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, আন্তর্জাতিক চাপ এবং সামরিক হুমকির মুখে আছে। তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা শক্তির নজর সবসময় সেদিকেই।
এ উদাহরণগুলো বিশ্বকে ইঙ্গিত দেয়—ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে শুধু তাকে নয়, বরং তার পেছনে থাকা শক্তিশালী পশ্চিমা জোটকেও শত্রু বানানো।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
ইসরায়েলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাইবেলীয় ইতিহাস, ইহুদি-খ্রিস্টান ধর্মীয় আবেগ। অনেক পশ্চিমা খ্রিস্টান রাষ্ট্র ইসরায়েলকে “ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি” হিসেবে দেখে। এই ধর্মীয় বোধ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও প্রতিফলিত হয়। ফলে মানবিক বিপর্যয় ঘটলেও তাদের সমর্থন পুরোপুরি প্রত্যাহার হয় না। ছোট প্যাসিফিক দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো এমনকি জাতিসংঘে ইসরায়েলের পক্ষে ভোট দিয়েছে ধর্মীয় কারণে।
দ্বৈত মান ও নীরব সমর্থন
স্পেন সম্প্রতি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে অস্ত্র বহনকারী জাহাজ ও বিমানকে তাদের বন্দর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু অন্য ইউরোপীয় দেশগুলো এখনো মৌখিক সমালোচনায় সীমাবদ্ধ। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স কিছুটা সক্রিয় হলেও জার্মানি বা ইতালি সরাসরি পদক্ষেপ নিতে ভয় পাচ্ছে। ইউরোপে “দ্বৈত মান” স্পষ্ট হয়ে উঠছে—একদিকে তারা মানবাধিকারের কথা বলে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে কঠোর ব্যবস্থা নেয় না।
মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোও কার্যত নীরব। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন—তারা ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে বা আলোচনায় আছে। ওআইসি বারবার বিবৃতি দিলেও বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। এ নীরবতা ইসরায়েলকে আরও সাহসী করে তুলছে।
কেন ভয় এখনো বিদ্যমান?
সব মিলিয়ে ইসরায়েলকে ভয় পাওয়ার কারণগুলো হলো—সামরিক শক্তি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার ও প্রতিশোধমূলক নীতি, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোটের অটল সমর্থন, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত নির্ভরতা, ধর্মীয় আবেগ ও সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং ইতিহাসে প্রতিপক্ষদের ভয়াবহ পরিণতি।
এ কারণেই আন্তর্জাতিক মহল জানে—ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মানে কেবল এক রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা নয়, বরং বহুমাত্রিক শক্তির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ানো। তাই ফিলিস্তিনিদের রক্তে ভিজে যাওয়া গাজার মাটি বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিলেও বাস্তব পদক্ষেপে নীরবতা বিরাজ করে।
ইসরায়েলকে ঘিরে ভয়ের সংস্কৃতি কেবল সামরিক বা পারমাণবিক শক্তির ফল নয়। এটি একটি বহুমাত্রিক বাস্তবতা—ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, যুক্তরাষ্ট্রের ছাতা, ধর্মীয় প্রভাব, অর্থনৈতিক নির্ভরতা এবং রাজনৈতিক দ্বৈত মানের সমন্বয়। যারা অতীতে এর বিরুদ্ধে গিয়েছিল, তাদের পতনের ইতিহাস এখন নতুন প্রজন্মের কাছে সতর্কবার্তা। তাই গাজার শিশুর কান্না, ভেঙে পড়া টাওয়ার, মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া মসজিদ—সবই মানবিক বিবেককে নাড়িয়ে দিলেও কার্যকর প্রতিরোধ দাঁড়িয়ে যায় না। বিশ্ব যেন মেনে নিয়েছে—ইসরায়েল একটি “অস্পর্শনীয় রাষ্ট্র,” যার বিরুদ্ধে যেতে চাওয়াই অনেক সময় নিজ ধ্বংস ডেকে আনে।
আপনার মতামত জানানঃ