ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের মতামত না নিয়েই আকস্মিকভাবে এই ঘোষণা দিয়েছে। ভিপি পদপ্রার্থী উমামা ফাতেমা বিষয়টিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অপমানজনক ও অযৌক্তিক বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, একটি অভ্যন্তরীণ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের পরিপন্থী। একইভাবে আরেক প্রার্থী সাদিক কায়েমও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কোনো আলোচনা ছাড়াই প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অংশীজনদের মতামতের প্রতি অবহেলার প্রমাণ।
শুধু প্রার্থীরাই নয়, সাবেক ছাত্রনেতারাও এই সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। সাবেক ভিপি এবং নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না উল্লেখ করেছেন, সামরিক শাসনের সময়েও ডাকসু নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়নি। তার মতে, ক্যাম্পাসে সেনা উপস্থিতি নতুন করে সংঘর্ষ ও উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে। সাবেক জিএস মুশতাক হোসেনও বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব প্রশাসনের উপরই ন্যস্ত, অতীতে সেই দায়িত্ব প্রশাসনই পালন করেছে। কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন পড়বে। তিনি আরও মনে করেন, ক্যাম্পাসে সেনা উপস্থিতি বরং অঘটনের আশঙ্কা বাড়াতে পারে।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যাখ্যা ভিন্ন। প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা পূর্বে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এবং সেই উদ্বেগ মেটাতেই সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব, আর সেই দায়িত্ব পালন করতেই সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রাখা হচ্ছে। তবে তিনি এটিও আশ্বাস দিয়েছেন যে, শিক্ষার্থীরা যদি এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত দেয়, তাহলে প্রশাসন সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসবে।
এবারের ডাকসু নির্বাচনে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রথম স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি সদস্য ও প্রক্টরিয়াল টিম, দ্বিতীয় স্তরে পুলিশ বাহিনী এবং তৃতীয় স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি প্রবেশমুখে সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকবে। সেনারা প্রয়োজনে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবে এবং ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র কর্ডন করে রাখবে। এছাড়া নির্বাচনকে ঘিরে আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে—নির্বাচনের সাত দিন আগে থেকে বহিরাগতদের হলে প্রবেশ নিষিদ্ধ রাখা, ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের ভোটদানের সুবিধার্থে অতিরিক্ত বাস ট্রিপ চালু করা, ভোটের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেট্রোরেল স্টেশন বন্ধ রাখা এবং পুরো ক্যাম্পাস সিলগালা করে দেওয়া। কেবল বৈধ শিক্ষার্থী, অনুমোদিত সাংবাদিক ও নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই নির্বাচনের দিনে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দাবি করছে, এসব নিরাপত্তা পদক্ষেপে প্রার্থীরা দ্বিমত পোষণ করেননি। তবে বাস্তবে তা ভিন্ন। অধিকাংশ প্রার্থী প্রকাশ্যে সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করেছেন এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন। তাদের মতে, এ ধরনের পদক্ষেপ নির্বাচনের স্বাভাবিক পরিবেশকে ব্যাহত করবে এবং গণতান্ত্রিক চর্চায় অযথা ভয়ভীতি তৈরি করবে।
সব মিলিয়ে, আসন্ন ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে একদিকে প্রশাসনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যুক্তি, অন্যদিকে শিক্ষার্থী ও প্রার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপের অভিযোগ—এই দুই অবস্থান স্পষ্টভাবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ফলে নির্বাচনের আগে থেকেই এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও বিতর্কের আবহ সৃষ্টি হয়েছে, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার উপরও প্রভাব ফেলতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ