ওড়িশার বালেশ্বর জেলার এক তরুণী শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক আত্মাহুতির ঘটনায় পুরো ভারত শোকস্তব্ধ। মাত্র ২০ বছর বয়সী এই ছাত্রীটি তারই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ করেছিলেন। অভিযোগ করেছিলেন একবার নয়, বহুবার। কখনও কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে, কখনও সামাজিক মাধ্যমে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ট্যাগ করে বিচারপ্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান কিংবা সমাজ—কেউই শোনেনি তার সেই আর্তনাদ।
শেষ পর্যন্ত আশাহত হয়ে গত শনিবার কলেজের অধ্যক্ষের ঘরের সামনে নিজ শরীরে আগুন লাগিয়ে দেন তিনি। ৯০ শতাংশের বেশি দগ্ধ অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় ভুবনেশ্বরের এইমস হাসপাতালে। সোমবার রাতে সেই তরুণী মৃত্যুর কাছে হার মানেন।
এই ঘটনা শুধু এক ব্যক্তির নয়, এটি একটি গোটা ব্যবস্থার ব্যর্থতার চিত্র। ভারতে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তা প্রয়োগে যে কতটা গাফিলতি ও অনিচ্ছা রয়েছে, এই ঘটনাই তার এক নির্মম প্রমাণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ কমিটি থাকলেও তা কীভাবে অভিযুক্তকে বাঁচিয়ে দিয়ে এক তরুণীকে আত্মাহুতির দিকে ঠেলে দিতে পারে, সেটি দেখা গেল এখানেই।
যে অধ্যাপক তার ছাত্রীকে দীর্ঘ ছয় মাস ধরে যৌন নিপীড়ন করছিলেন, তার বিরুদ্ধে প্রথমে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। উল্টো তাকে ‘ক্লিন চিট’ দেওয়া হয় অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে। অভিযোগকারিণী ছাত্রীকে পরীক্ষায় ফেল করার ভয় দেখানো হয়, ক্লাসে অনুপস্থিত থাকার অজুহাতে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয় না। মানসিকভাবে এমন নিপীড়নের মুখে পড়ে তিনি একসময় ভেঙে পড়েন।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী একে ‘সংগঠিত হত্যা’ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, “ওই ছাত্রী সুবিচারের জন্য লড়াই করেছিল, কিন্তু রাষ্ট্র তাকে প্রতারণা করেছে।” কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান অবশ্য এই মন্তব্যকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা বলে নিন্দা করেছেন। তবু সত্যটা থেকে যাচ্ছে—যদি সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে হয়তো এই তরুণীকে জীবন দিতে হতো না।
ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝি দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। ইতিমধ্যে অভিযুক্ত অধ্যাপক এবং কলেজের অধ্যক্ষ—যিনি ওই অধ্যাপককে আড়াল করতে ভূমিকা রেখেছিলেন—উভয়েই গ্রেপ্তার হয়েছেন।
তবে প্রশ্ন রয়ে গেছে—এই দু’জনের শাস্তিই কি যথেষ্ট? যেসব অভ্যন্তরীণ কমিটি যৌন হয়রানির মতো গুরুতর অভিযোগ ধামাচাপা দিতে ভূমিকা রেখেছে, তারা কি দায়মুক্তি পাবে? যারা মানসিকভাবে এক তরুণীকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিলো, তারা কি কখনও বিচার পাবে না?
ওই ছাত্রীর পরিবার বলেছে, শুধু দু’জনকে গ্রেফতার করলেই হবে না। যারা মিথ্যা তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছে, যারা অভিযোগকে অগ্রাহ্য করেছে, তারাও সমানভাবে দায়ী। এই ঘটনাটি একটি উদাহরণ নয়, এটি ভারতীয় সমাজে নারীদের প্রতি অব্যাহত সহিংসতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির এক জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি।
এই মর্মান্তিক ঘটনার মধ্যেও উঠে আসে এক তরুণীর সাহস—যিনি ভয় পাননি, মুখ খুলেছিলেন, প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সমাজ তাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আজ তার মৃত্যুর পরে দেশ জুড়ে আলোচনা হলেও, সত্যিকারের পরিবর্তন তখনই আসবে যখন কোনো শিক্ষার্থী, কর্মী বা নারী কণ্ঠস্বর তুললে সেটিকে ধামাচাপা না দিয়ে গুরুত্ব দিয়ে শোনা হবে।
না হলে এমন মৃত্যুর মিছিল থামবে না। শুধুমাত্র বিচার নয়, প্রয়োজন সচেতনতা, সহানুভূতি এবং সাহসিকতার পাশে দাঁড়ানোর শক্তিশালী সংস্কৃতি।
আপনার মতামত জানানঃ