প্রতিবেশি দেশগুলোতে নিজেদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে ভারত-চীন দ্বৈরথের ভ্যাকসিন নিয়ে কূটনীতি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াটা স্বাভাবিক। দুই দেশের মধ্যকার এমনিতেই অর্থনীতি রাজনীতি বিষয়ে দ্বন্দ্ব ছাড়াও প্রতিবেশি দেশগুলোতে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের তোড়জোড় লক্ষণীয়। এরই অংশ হিসাবে ভ্যাকসিন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে দুদেশ। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারতের হস্তক্ষেপের কারণেই চীনের তৈরি করোনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বাংলাদেশে স্থগিত করা হয়েছিল বলে গত মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত ওই পত্রিকাটি দাবি করে যে, ঢাকায় ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য বেইজিংয়ের প্রচেষ্টা আটকে দিতে নয়াদিল্লি নেপথ্য ভূমিকা রেখেছে।
২০২০ সালের অক্টোবরের দিকে ঢাকায় ‘করোনভ্যাক’ ভ্যাকসিন সরবরাহের জন্য শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছিল বেইজিং। ওই চুক্তির একটি শর্ত ছিল ঢাকাকে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের খরচ ভাগ করে নিতে হবে। ঢাকা থেকে ট্রায়ালের খরচ দিতে অস্বীকৃতি জানানো হলে চীনা প্রতিষ্ঠানটি বলেছিল যে, সিনোভ্যাক যেসব দেশে ক্লিনিকাল ট্রায়াল চালিয়েছে সব দেশের জন্যই একই শর্ত রাখা হবে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। এরপরেই ঢাকা দিল্লির কাছে দ্রুত অগ্রসর হয় এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের তিন কোটি ডোজ বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহের জন্য মোদি সরকারের মাধ্যমে সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী অক্টোবর মাসে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছিলেন যে, মূল চুক্তির বাইরে যেয়ে সংস্থাটি আংশিক অর্থায়ন দাবি করায় ঢাকা এ বিষয়ে আর এগোবে না। তিনি বলেন, ‘আমরা ট্রায়ালের তহবিলে অর্থায়ন করছি না। সেটা চুক্তিতে ছিল না। তারা যখন আমাদের কাছে এসেছিল তখন কোন অর্থই চায়নি … চুক্তি অনুসারে, তারা ট্রায়ালের সমস্ত ব্যয় বহন করবে, তারা আমাদেরকে ১ রাখ ১০ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দেবে এবং তারা প্রযুক্তিটি আমাদের সাথে ভাগ করে নেবে যাতে আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলো ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে।’
তবে গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই মাসে সাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে আগস্টে ট্রায়াল শুরু হওয়ার কথা ছিল। তারা এটিও নিশ্চিত করেছে যে, প্রাথমিক চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশকে কোন ব্যয় বহন করতে হবে না বলে নিশ্চিত করা হয়েছিল। তবে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতায় ভারত সরকার আপত্তি করার কারণে, ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলো অক্টোবর পর্যন্ত বিলম্বিত করা হয়। গত ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কাছে সিনোভাক বায়োটেকের লেখা চিঠি অনুসারে, ঢাকা অনুমোদন দিতে বিলম্ব করায়, আগস্টে নির্ধারিত ট্রায়াল পিছিয়ে যায়।
সিনোভাক বায়োটেক আরও দাবি করেছে যে, তারা নতুন সংক্রামক রোগগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ভ্যাকসিনের বিকাশ করার জন্য গঠিত সংস্থা ‘কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপার্ডনেস ইনোভেশনস’কে (সিইপিআই) বাংলাদেশে ট্রায়াল চালানোর ব্যাপারে তহবিল সরবরাহের জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়।
প্রতিবেশী দেশগুলো তো বটেই গোটা বিশ্বেই ‘ভ্যাকসিন কূটনীতি’ অব্যাহত রেখেছে ভারত। এতে উপকৃত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোতে নিজেদের প্রভাব ক্ষুণ্ন হওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন চীন। দেশটিও শুরু করেছে ভ্যাকসিন কূটনীতি। এরই মধ্যে পাকিস্তানকে চীনের পাঁচ লাখ ভ্যাকসিন উপহার তারই লক্ষণ। এদিকে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত কোভিশিল্ড বাংলাদেশে রপ্তানির আগে মোদি সরকার উপহার হিসাবে বাংলাদেশকে ২০ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়েছেন।
চীনা সংশ্লিষ্টদের দাবি, ভারতের বাগড়া দেওয়ার কারণে বাংলাদেশে চীনা কোভ্যাক্সের ট্রায়াল আটকে যায়। আর তার সুযোগ নিয়ে ঢুকে পড়ে ভারত।
আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দুইদেশের ভ্যাকসিন রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ চীনা ভ্যাকসিনকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রবেশে নিষেধ করা। তারই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সহ নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপেও ভারত উপহার হিসাবে ভ্যাকসিন পাঠিয়েছে। এছাড়া মরিশাসও পেয়েছে ভারতের উপহারের টিকা।
এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ (ট্রায়াল) করতে যাচ্ছে আনুই জিফেই নামের একটি চীনা প্রতিষ্ঠান। টিকার পরীক্ষার পাশাপাশি তারা যৌথ গবেষণা ও উৎপাদনের কারখানাও স্থাপন করতে চায়। দেশে টিকার পরীক্ষা করতে আসা চীনা প্রতিষ্ঠানটি হলো আনুই জিফেই লংকম বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড। বেইজিং থেকে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি থেকে জানানো হয়, টিকা পরীক্ষা সফলভাবে শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশে যে টিকা উৎপাদিত হবে, তার একাংশ মুজিব বর্ষের উপহার হিসেবে পাবে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৭
আপনার মতামত জানানঃ