বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই একধরনের স্বস্তিদায়ক অবস্থানে ছিল, তবে এখন হয়তো প্রথমবারের মতো কিছু চাপের মুখে পড়তে চলেছে—এ চাপটা বাইরের কারও নয়, বরং তাদের নিজেদের আত্মবিশ্বাস থেকে সৃষ্ট।
কিছুটা পেছনে ফিরি। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে যত সরকার এসেছে, তাদের সবাইকে প্রথম দিন থেকেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আমলে জাসদ সক্রিয় ছিল, যার মূল লক্ষ্যই ছিল সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করা। জিয়ার আমলে আওয়ামী লীগ বিরোধিতার মোর্চায় ছিল। এরশাদের সময় প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠন রাজপথে সক্রিয় ছিল। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লীগ ফল মেনে নেয়নি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি কারচুপির অভিযোগ তোলে। সংসদ বয়কটের রাজনীতি চলে আসছে বছরের পর বছর।
২০০৮ এর নির্বাচনের পরও বিরোধিতার ধারা অব্যাহত ছিল। এরপর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলোতে সরকারের প্রতি অভিযোগ আরও ঘনীভূত হয়েছে। একপর্যায়ে সরকার শুধু বিরোধী দল নয়, পুরো জাতিকে যেন প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে।
তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারগুলো ইতিহাসে অল্প সময়ের জন্য এলেও, ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকারের কথা আলাদা করে বলা যায়। যদিও শুরু থেকেই বিএনপি-জামায়াত এর বিরোধিতা করেছিল। অথচ এবারের অন্তর্বর্তী সরকার, যেটা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে, প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেয়েছে। শুরুতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দেশে ছিল না, আর তৃণমূল পর্যায়ে দলের কর্মীরাও বিরোধিতা করেনি। বরং তারা আগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিরক্ত ছিল এবং নতুন নেতৃত্বের অপেক্ষায় ছিল।
বাকি দলগুলোও অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। তাদের একমাত্র চাওয়া ছিল অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন। যদিও এই চাওয়ার ধরনে কিছু পার্থক্য ছিল—বিএনপি চেয়েছিল দ্রুত নির্বাচন, জামায়াত কিছু সময় নিয়ে, আর নতুন উদীয়মান এনসিপি (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি) চাইছিল বিলম্বিত নির্বাচন। এই এনসিপির সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতা দেখে অনেকে তাদের ড. ইউনূসের ‘পছন্দের দল’ বলে বিবেচনা করতে শুরু করেছে।
সরকারকে প্রকাশ্য বিরোধিতা কেউ করছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে—যেমন রাখাইন রাজ্যে ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে প্রস্তাব, চট্টগ্রাম বন্দরের একটি লাভজনক টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার চেষ্টা এবং ইশরাক হোসেনের মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণে বাধা সৃষ্টি। এই ইস্যুগুলো সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্কেও টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে বলে গুঞ্জন আছে।
সরকারি উপদেষ্টাদের বক্তব্যেও কিছুটা অহংকার ও চাপা উত্তেজনার ছাপ দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এত তাড়াহুড়া কেন? এর পেছনে কি কোনো আন্তর্জাতিক চাপ বা গোপন চুক্তি কাজ করছে? এমন যদি হয়, তাহলে দেশের সাধারণ জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করা কি আত্মঘাতী নয়? আমরা গরিব হতে পারি, কিন্তু সম্মান ও স্বাধীনতা নিয়ে আপস করতে রাজি নই।
আপনার মতামত জানানঃ