দেশের রফতানি আয়ের বেশির ভাগ আসে তৈরি পোশাকের মাধ্যমে। রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে এখনো সফল হয়নি বাংলাদেশ। তবে বর্তমানেও যে সক্ষমতা আছে তাতে রফতানি আরো বেশি হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
দেশের রফতানি আয়ের বেশির ভাগ আসে তৈরি পোশাকের মাধ্যমে। রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে এখনো সফল হয়নি বাংলাদেশ। তবে বর্তমানেও যে সক্ষমতা আছে তাতে রফতানি আরো বেশি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর রফতানির পরিমাণ শত বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি ২০২৬ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে বলে প্রক্ষেপণ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সম্প্রতি সংস্থাটির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। অবশ্য বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের ফলে এ রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এডিবি সম্প্রতি ‘রোডম্যাপ ফর ইনভেস্টমেন্ট পলিসি রিফর্মস অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে ২০২৬ সালে তৈরি পোশাক রফতানি ৫১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে অতিরঞ্জিত পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। রফতানি আয়ের অতিরঞ্জিত তথ্যের কারণে প্রতি বছরই ব্যালান্স অব পেমেন্টে (বিওপি) ট্রেড ক্রেডিটে বড় অংকের ঘাটতি দেখা যেত। রফতানির অর্থ প্রত্যাবাসিত না হওয়ার কারণে এ ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে বিগত সরকারের সময়ে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে রফতানি আয়ের তথ্য সংশোধনের পর দেখা গেছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রফতানির পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। সংশোধিত তথ্যানুসারে আলোচ্য অর্থবছরে তৈরি পোশাক রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬ বিলিয়ন ডলার। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা ছিল ৩৮ বিলিয়ন ডলারে।
বিজিএমইএর তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে দেশের তৈরি পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ২৭ বিলিয়ন ডলার। এর পরের বছর ২০২১ সালে এটি দাঁড়ায় ৩৬ বিলিয়ন ডলারে। ২০২২ সালে রফতানির পরিমাণ আরো বেড়ে হয় ৪৬ বিলিয়ন ডলার। তবে এরপরের দুই বছরে তৈরি পোশাক রফতানির পরিমাণ নিম্নমুখী।
হোয়াইট হাউজে গত ২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে নতুন রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় সব দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশী পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এর সঙ্গে আগের ১৫ শতাংশ শুল্ক যোগ করা হলে কার্যকর শুল্কের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫২ শতাংশে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য তিন মাসের জন্য এ শুল্ক আরোপের বিষয়টি স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বজুড়ে এ শুল্ক আরোপের কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। শঙ্কা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের একক বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি নিয়েও। এ বাস্তবতায় সামনের বছর তৈরি পোশাকের রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপের আগে ও পরের পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। এডিবির প্রক্ষেপণে বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনা করা হয়েছে কিনা সেটি আমি জানি না। তবে এ শুল্ক যদি বলবৎ থাকে তাহলে ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রফতানি আয় অর্জন করা অনেক চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ বাড়তি ব্যয় সামাল দিয়ে মুনাফা করার পাশাপাশি আগের মতো প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা খুব কঠিন হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পুরো পৃথিবী জুড়েই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর প্রভাবে সব দেশের অর্থনীতিই দুর্বল হবে। প্রবৃদ্ধি কমে যাবে, সেই সঙ্গে চাহিদা ও ক্রয়ক্ষমতাও কমবে। তাছাড়া সহজে বিকল্প বাজার খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। নতুন বাজারেও শুল্কের কারণে চাহিদা কম থাকবে। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধার না হওয়ার আগ পর্যন্ত নতুন বাজার খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। অবশ্য যদি এ শুল্কের বিষয়টি না থাকত তাহলে ৫০ বিলিয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা তেমন কঠিন ছিল না।’
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য পণ্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের বাণিজ্যের আকার ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের অর্থমূল্য ২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। আর বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে রফতানি পণ্যের অর্থমূল্য ৮ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, যার ৮৭ শতাংশই আবার তৈরি পোশাক পণ্য। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ট্রাম্পের নতুন শুল্ক-খড়্গের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে। বিষয়টি নিয়ে তাই সবচেয়ে বেশি চিন্তিত এ খাতের ব্যবসায়ীরা। ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারক কারখানা মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন ক্রেতারা। রফতানিকারক কারখানা কর্তৃপক্ষও মার্কিন ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে শুল্কের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে ক্রেতাদের পক্ষ থেকেই যোগাযোগ করা হচ্ছে রফতানিকারকদের সঙ্গে। সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, মার্কিন পোশাক ক্রেতাদের মধ্যে কেউ কেউ এরই মধ্যে ঘোষিত নতুন শুল্ক কাঠামোর সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়ন শুরু করে দিয়েছেন। সে অনুযায়ী কারখানা মালিকদের জন্য দিকনির্দেশনাও আসতে শুরু করেছে। কোনো কোনো ক্রেতার পক্ষ থেকে আবার আরোপিত নতুন শুল্ক রফতানিকারকদেরই পরিশোধ করতে বলা হচ্ছে। তাছাড়া নতুন ক্রয়াদেশ বাতিলসহ চলমান উৎপাদন স্থগিতের নির্দেশনাও আসতে শুরু করেছে।
প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাতের প্রকৃত প্রবৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নিলে এ সময়ের মধ্যে মনে হয় না যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি করা সম্ভব হবে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের কারণে রফতানিতে প্রভাব পড়বে। শুল্কের কারণে সারা বিশ্বেই প্রভাব পড়বে। তাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কতটুকু প্রভাব পড়বে সেটি আরো পরে বোঝা যাবে। তবে তা সত্ত্বেও রফতানিতে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি হবে। গত বছর পোশাক খাতে রফতানির ক্ষেত্রে প্রায় ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ বছরও পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ১২-১৫ শতাংশের মতো হতে পারে।’
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৯ মাসে দেশের তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বমুখী ধারা দেখা গেছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে। যেখানে আগের অর্থবছরে একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ২৭ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে রফতানি বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। এ ধারা বজায় থাকলে অর্থবছর শেষে তৈরি পোশাক রফতানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পোশাক খাতে রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানো সম্ভব হবে যদি যুক্তরাষ্ট্র কোনো অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ না করে এবং সরকার যদি ২০২৬ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম আর না বাড়ায়।’
বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। যদিও রফতানি আয়ের দিক থেকে বৈশ্বিক তালিকায় অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার দিক থেকে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বার্ষিক রফতানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারের নিচে কেবল তিনটি দেশের, যার অন্যতম বাংলাদেশ। অন্য দেশ দুটি হলো পাকিস্তান ও নাইজেরিয়া। এমনকি এশিয়ার উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশ এখনো রফতানিতে বেশ পিছিয়ে।
গত বছর ২০২৪-২৭ সময়কালের জন্য জাতীয় রফতানি নীতি অনুমোদন করা হয়। এতে ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে দেশের রফতানি আয়ের পরিমাণ ১১০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত তৈরি পোশাক রফতানিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেলেও সার্বিক রফতানির পরিমাণ খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। মূলত নীতি দুর্বলতা ও বড় জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে না পারার কারণেই এ খাতে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছে না বলে মত বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, প্রতিযোগী দেশগুলোর অর্থনীতির সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। এর কারণ রফতানির ক্ষেত্রে নগদ প্রণোদনা ছাড়া সরকারের যেসব নীতি রয়েছে, সেগুলো যথেষ্ট সহায়ক নয়। অন্যদিকে প্রতিযোগী দেশগুলো বাংলাদেশের চেয়ে কম জনসংখ্যা নিয়েও রফতানির পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পোশাক রফতানি ৫০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে কিনা, সেটা বলা মুশকিল। কারণ শুল্কযুদ্ধের কারণে আমেরিকায় ভোক্তার সংখ্যা কমবে। ক্রেতাদের চাপ এবং আমাদের নিজেদের কারখানার চাকা চালানোর তাগিদে কমবে তৈরি পোশাকের দাম। একই সঙ্গে প্রতিযোগী দেশগুলো আমাদের ব্যবসার বেশ খানিকটা নিয়ে যাবে। কাজেই বাংলাদেশ আগামীতে কেমন করবে তা নির্ভর করছে বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক কৌশলের ওপর। সোজা কথায় আমাদের অত্যন্ত কার্যকর অর্থনৈতিক কূটনীতি প্রয়োজন।’
আপনার মতামত জানানঃ