উৎপল রায় : সংবিধান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও দেশে থেমে নেই হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু। সম্প্রতি সিলেটে পুলিশের হেফাজতে যুবককে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনায় এ নিয়ে আবারও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। মানবাধিকার ও আইনি সহায়তা সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে গ্রেপ্তারের আগে-পরে পুলিশের হাতে শারীরিক নির্যাতনে ১৪ জন মারা গেছেন। একই সময়ে পুলিশের হেফাজতে থাকাবস্থায় অসুস্থ হয়ে তিনজন এবং একজন আত্মহত্যা করেছেন বলে জানিয়েছে তারা।
গত ১১ অক্টোবর সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নগরের আখালিয়ার যুবক রায়হান আহমদ (৩৩) নিহত হওয়ার পর এ নিয়ে দেশজুড়ে বইছে সমালোচনা-নিন্দার ঝড়। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথমে ছিনতাইয়ের অভিযোগে পিটুনিতে রায়হান নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। পরে জানা যায়, ওই পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে নির্যাতন চালানোর ফলে মারা যান রায়হান। তার শরীরে নির্যাতন ও আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ঘটনার পর থেকে এসআই আকবর পলাতক। সিলেটের এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ঢাকার নবাবগঞ্জে থানা হাজতের টয়লেট থেকে হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি মামুনের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়। পুলিশের দাবি, মামুন গত মঙ্গলবার দুপুরে হাজতের টয়লেটের ভেতরে গ্রিলের সঙ্গে নিজের লুঙ্গি দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
আদালতের পরোয়ানা কিংবা বিনা পরোয়ানায় আটক-গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে কাউকে নির্যাতন ও নির্যাতনজনিত কারণে কারও মৃত্যু হলে ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ)’ আইনে বিচারের বিধান রয়েছে। ২০১৩ সালে আইনটি হলেও সাত বছরে এ আইনে মাত্র একটি মামলার বিচার হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বিনা পরোয়ানায় কোনো ব্যক্তিকে আটক-গ্রেপ্তার এবং ১৬৭ ধারা অনুযায়ী পুলিশের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) বিষয়ে কাউকে কোনো ধরনের শারীরিক নির্যাতন না করাসহ ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকার এবং আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকারের কথা বলা আছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। মানবাধিকারকর্মী ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংবিধান, আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে পাত্তা দেন না।
নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে কাউকে নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণ হলে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং আর্থিক দণ্ড, নির্যাতনের ফলে কারও মৃত্যুর অভিযোগ প্রমাণ হলে সংশ্লিষ্টদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং অতিরিক্ত দুই লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে দিতে হবে। আর এ ধরনের অপরাধ সংঘটনে কেউ উদ্যোগী হলে বা প্ররোচনা দিলে ১০ বছর কারাদণ্ড ও আর্থিক দণ্ডের বিধান রয়েছে।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর পল্লবী থানায় ইশতিয়াক হোসেন জনি নামে এক যুবককে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনায় হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইনে প্রথম এবং ঐতিহাসিক রায় হয় গত ৯ সেপ্টেম্বর। ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের রায়ে ওই থানার বরখাস্ত এসআই জাহিদুর রহমান খানসহ দুজন সহকারী উপপরিদর্শককে (এএসআই) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং পুলিশের দুই সোর্সকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজনকে এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ডের পাশাপাশি নিহত জনির পরিবারকে দণ্ডপ্রাপ্ত ওই তিনজনকে দুই লাখ টাকা করে মোট ছয় লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও আদেশ হয়।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও আসকের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট জেড আই (জহিরুল ইসলাম) খান পান্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, এই একটি ব্যতিক্রম (জনি হত্যা মামলা) ছাড়া এই আইনের অন্তত ১৮টি মামলার মধ্যে বেশিরভাগেরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। আর কোনো মামলায় এখন পর্যন্ত অভিযোগ গঠন হয়েছে বলে তাদের জানা নেই। তবে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া মামলাগুলোকে সচলের চেষ্টা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন একটি প্র্যাকটিসে (অভ্যাস) পরিণত হয়েছে। এখন থেকেই যদি এগুলো শক্ত হাতে মোকাবিলা করা না যায়, তাহলে এসব বন্ধ করা খুব কঠিন হবে। সিলেটে সিসিটিভি (ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা) ফুটেজে যদি সত্যি ঘটনা ধরা না পড়ত তাহলে পুলিশ প্রশাসন তো নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করত।’ তিনি আরও বলেন, ‘অপরাধীরা অপরাধ করবেই। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো অপরাধীর মতো আচরণ করতে পারে না। আমার মনে হয়, তাদের চাকরিতে প্রবেশের আগে যে প্রশিক্ষণ তা আরও যুগোপযোগী, মানবতা উপযোগী এবং কর্তব্যনিষ্ঠ উপযোগী হওয়া উচিত।’
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আসলে আমাদের দেশে পুলিশের হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি প্রযুক্তিনির্ভর নয়। এর কারণ হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা যে, মারধর-নির্যাতন না করলে কেউ তথ্য দেয় না, দোষ স্বীকার করে না। পুলিশের ক্ষমতা জাহির করার জন্য, এক ধরনের ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে এই চর্চা ও মানসিকতা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশে সংস্কার, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক কাজে পুলিশকে ব্যবহার না করা, প্রতিটি থানার অন্দরসহ এসব ঘটনায় সুরতহাল, পোস্টমর্টেমের বিষয়টি সিসিটিভির আওতায় আনা হলে এ ধরনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসবে।’
প্রবীণ আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার নিয়ে সংবিধান ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু নির্দেশনা প্রতিপালনের মানসিকতা তো থাকতে হবে। নির্দেশনা প্রতিপালনের সংস্কৃতি চালু না হলে এসব অপরাধ কমবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে দ্রুত বিচার না হলে যারা অপরাধ করছে তারা পার পেয়ে যায়। তাই তদন্ত শেষ করে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা উচিত। আর বিচার চলাকালীন কোনো মুলতবি রাখা যাবে না। মুলতবির কারণে বছরের পর বছর চলে যায়। বিচারে দীর্ঘসূত্রতা বাড়ে। সাক্ষী হারিয়ে যায়। দ্রুত বিচার হলে যাদের এ ধরনের মনোবৃত্তি তারা অপরাধের সাহস পাবে না। অপরাধও নিয়ন্ত্রণে আসবে।’
আপনার মতামত জানানঃ