বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসনে ডিসি নিয়োগে লেনদেন ও প্রতিবেশী দেশের সম্পৃক্ততার কথোপকথন ফাঁস হয়েছে। এই কথোপকথনে দেখা যায়, এই নিয়োগের জন্য জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব মোখলেছুর রহমান ও দুইজন যুগ্ম সচিব দেশে-বিদেশে ডলার ও টাকায় বিপুল অর্থ গ্রহণ করেছেন। বেসামরিক প্রশাসন নিয়ে ফাঁস হওয়া এই কেলেঙ্কারিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের নিয়োগেও লেনদেন ও বোঝাপড়ার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। আর এর পেছনে সরাসরি নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা প্রতিবেশী দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা পালন করেছে মর্মে সিনিয়র সচিব ও যুগ্ম সচিবের কথোপকথনে জানা যায়। বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আবু সালেহ আকন।
প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, মাঠ প্রশাসনে প্রতিবেশী দেশের আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের নিয়োগের মূল উদ্দেশ্য হলো এ বছরের শেষ নাগাদ গণহত্যার দায়ে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া পতিত স্বৈরাচার হাসিনাকে যাতে ক্ষমতায় আবার ফিরিয়ে আনা যায়। এ মিশন সফল করতে তারা মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে এবং এ জন্য তারা কয়েকজন ছাত্র সমন্বয়ককে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। এসব ভয়াবহ তথ্য ফুটে ওঠে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেছুর রহমান ও বিতর্কিত যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদের গোপন হোয়াসআ্যপ চ্যাটিংয়ে।
তাদের উভয়ের এ কথোপকথনের অতি সংবেদনশীল কিছু অংশের স্ক্রিনশট এ প্রতিবেদকের হাতে চলে আসে। মূলত রাষ্ট্রের অতি উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র থেকে এবং শীর্ষ কয়েকজন ছাত্র সমন্বয়কের মাধ্যমে আমাদের এ প্রতিবেদকের হাতে এ কথোপকথনগুলো হস্তগত হয়েছে। ১০টি স্ক্রিনশটের ছবিতে কথোপকথন হয় এ দুইজনের।
সূত্র মতে, ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি উইংয়ের যুগ্ম সচিব এবং জনপ্রশাসন সচিব মোখলেছুর রহমানের পাশাপাশি জেলায় বাড়ি হওয়ার সুবাধে তারা আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ। আরেক বিতর্কিত যুগ্ম সচিব আলী আযম ও ড. জিয়াউদ্দিন উভয়ে বেশ ঘনিষ্ঠ। মূলত শেষোক্ত দুইজনের পরামর্শে দুইজন ছাত্র সমন্বয়কের তদবিরে ও কথিত সমন্বয়ক তানভীরের চাপে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় মোখলেছুর রহমানকে জনপ্রশাসনে সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়। তার নিয়োগের সামারি প্রস্তুত থেকে শুরু করে সামারি অনুমোদন এবং হাতে করে অনুমোদিত সামারি-সহ মোখলেছুর রহমানের যোগদানের (২৮ আগস্ট) দিনও তানভীর সশরীরে উপস্থিত ছিলেন।
গত ২৮ আগস্ট থেকেই তাদের (জিয়া-মোখলেছ) কথোপকথন হস্তগত করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। যেটার শুরু হয় অভিনন্দন বার্তা দিয়ে। জনপ্রশাসন সচিব জিয়াকে ফোনে কথা না বলে সরাসরি কথা বলতে বলেন। মোখলেছ উল্লেøখ করেন, এখন তিনি সংবেদনশীল চেয়ারে আছেন এবং তাকে গোয়েন্দারাসহ সবাই ফলো করছে। এ ফাঁকে তাদের হোয়াটসআ্যপ কলেও কথা হয়। জনপ্রশাসন সচিব জিয়াকে মেসেজ দিয়ে বলেন, ‘যা করবা সাবধানে করবা। হোয়াটসআ্যাপ ছাড়া টেকস্ট দিবা না।’ জিয়া প্রতি উত্তরে বলেন- ‘ঠিক আছে স্যার, আমি সব গুছাই আসছি এখন কেউ কিছু করতে পারবে না’।
একটি মেসেজে সিনিয়র সচিব নিজেকে নির্লোভ দাবি করে মাত্র পাঁচ কোটি টাকার একটি আবদার করলে জিয়া তাকে সুখবর দিয়ে বলেন, ১০ কোটি রেখেছি আপনার জন্য। তিনি সন্তুষ্ট হয়ে বলেন, আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা যেটা ভালো হয় করো। টাকা পয়সার প্রতি তেমন লোভ নাই আমার। গিরগিটিগুলোর (গোয়েন্দা) দিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দেন সচিব মোখলেছ। জিয়া অভয় দিয়ে বলেন, ‘আমি সতর্ক আছি, আপনি টেনশন নিয়েন না।’ সচিব তার কাছে অর্ধেক ডলারে আর বাকিটা তার লোকের কাছে নগদে দেয়ার জন্য বলেন। আশঙ্কিত সচিব জানতে চান হোয়াটসআ্যাপে কোনো প্রবলেম আছে কি না। জিয়া পূর্ণ অভয় দিয়ে বলেন- ‘হাসিনাই পারে নাই, আর এখন তো গোয়েন্দাগুলো দুর্বল।’
চতুর্থ স্ক্রিনশটে একটি টেক্সটে ড. জিয়া প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, তারা ৫০/৫২ জন জেলা প্রশাসক তাদের চয়েজে দেয়ার জন্য দাবি করেছে, অন্যথায় তারা ঝামেলা পাকাবে। বিনিময়ে তারা ২০০ কোটি দিচ্ছে এবং এ পেমেন্ট কিভাবে হবে- সিঙ্গাপুরে নাকি থাইল্যান্ডে দিবে সে জন্য তার মতামত চেয়েছে। সচিব এ বিষয়ে জিয়া ও আযমকে ঠিক করতে বলেন। তারপর ওই দিন রাতে তারা অনেকবার কথা বলেছেন মর্মে রেকর্ডে দেখা যায়।
কথোপকথনে জিয়া সচিবকে নিশ্চয়তা দেন । সচিব অগ্রিম পাঁচ কোটি দাবি করার পাশাপাশি ডিসি লিস্ট গোপনে টাইপ করে নিয়ে আসতে বলেন। আর তাতে বিদ্রোহ এড়াতে ফরিদা (চট্টগ্রাম), সাইফুল (খুলনা), আফরোজা (বগুড়া) ও তানভীরকে (ঢাকা) রাখতে পরামর্শ দেয়া হয়। এভাবে চলে তাদের দীর্ঘ আলাপ। তাতে বলা হয় গোপনে ভোরে যোগাযোগ করার কথা এবং ৯ ও ১০ তারিখে জিও করার গ্যারান্টির বিষয়টি, তবে এর আগে পেমেন্ট ক্লিয়ার করার কথা বলেন সিনিয়র সচিব। জিয়া বলেন, সব তিনি ও আযম ঠিক করে ফেলেছেন।
বাকি আলাপে সচিব বলেন, ‘ওদিকে কী অবস্থা, আপডেট দাও’। জবাবে জিয়া লিখেন, ‘আমি আর আজম মিলে সব ঠিক করে ফেলেছি স্যার, আপনি টেনশন নিয়েন না। সিস্টেমে এপিডিকে কাজ দিয়ে বাইরে রাইখেন। উনি যেনো ঝামেলা করতে না পারে।’ সচিব বলেন, সবকিছু ঠিকঠাক করো আর তুমি ওরে নিয়ে টেনশন কইরো না, ওরে সিস্টেমে ফেলে দিবো আর কেউ কিছু বললে আমার নাম বলবা না, আলী ইমাম স্যার আর আহসান কিবরিয়ার নাম বলবা। বলবা যে উনারা সবকিছু ঠিকঠাক করেছেন। ডিসিও উনারা বানাবেন। কারণ পোলাপাইন ওনাদের কাছে পৌঁছাইতে পারবে না।
জিয়া বলেন, ‘জি স্যার, এখন আকমল স্যারকে হাতে রাখবেন একটু সাপোর্ট দরকার। উনি তো প্রথম দিন অফিসারদের আদমজী বলে গালি দিছিলো। এই কারণে অফিসাররা উনার উপর বিরক্ত। একটু উসকাইয়া দিলে উনি চাপে থাকবে। তাহলে তার উপর কিছু চালাইয়া দেয়া যাবে। অফিসাররা মনে করবে যে, উনি আগে থেকে ওদের উপর অসন্তুষ্ট, এ জন্য ওদের দেয় নাই।’ সচিব বলেন, ‘ঠিক আছে তুমি এগুলো নিয়ে ভেবো না। আমি মিয়া পুরাতন খেলোয়াড়, তোমরা তোমাদের কাজ করো।’
জিয়া বলেন, ‘জি স্যার। জি স্যার। আপনি স্যার আমার আর আযমের ওপর আস্থা রাখেন। ধন্যবাদ স্যার।’ সচিব বলেন, ‘দেখলাম তোমরা আহসান কিবরিয়াকে কিভাবে বিতর্কিত করে ফেলছ। এটা অবশ্য সুবিধা হইছে আমাদের জন্য।’
এই চ্যাটিং-এর বিষয়ে জানতে জনপ্রশাসন সচিব মোখলেছুর রহমানের সাথে যোগাযোগের জন্য তার মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেয়া হলে তিনি ফোন ধরেননি। যুগ্ম সচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সচিবের সাথে হোয়াটসঅ্যাপে তার কোনো চ্যাট হয়নি। এমনকি, ফোনেও তেমন কথা হয় না। প্রয়োজন হলে তিনি ডেকে পাঠান। এই চ্যাটিংএর স্ক্রিনশট আর্টিফিসিয়ালভাবে তৈরি করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করে বলেন, প্রয়োজনে পুলিশকে দিয়ে ভেরিফাই করা যেতে পারে
আপনার মতামত জানানঃ