অন্তত যদি গত এক দশকের পাকিস্তান সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পরিভাষার ব্যবহার বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে বৈশ্বিক গণমাধ্যম পাকিস্তান রাষ্ট্রকে নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করেছে। কখনও ‘দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্র’ তো কখনও ‘অনিরাপদ রাষ্ট্র’। কখনও ‘ক্লাইন্ট রাষ্ট্র’ তো আবার কখনও ‘ফারাইয়া রাষ্ট্র’। কখনও ‘রগ স্টেট’ তো আবার কখনও ‘সেমি-ব্যর্থ রাষ্ট্র’ ও ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশেষণগুলো দুই শব্দের হলেও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এই পরিভাষাগুলোর গুরুত্ব অনেক জটিল ও গভীর। আমরা যদি এই পরিভাষাগুলোর সংক্ষিপ্ত অর্থ বিশ্লেষণ করি তাহলে শুরু করা যায় ‘দুর্নীতি পরায়ণ’ রাষ্ট্রের সংজ্ঞায়ন দিয়ে। ‘দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্র’ হলো দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা। এক্ষেত্রে মনে হয় বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, কারণ আমাদের মত বহুমাত্রিক দুর্নীতিতে জর্জরিত একটি দেশের মানুষের কাছে এর অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কার। এই বিশেষণের প্রমাণও পাওয়া যায় সর্বশেষ দুর্নীতির ধারণা সূচকে (সিপিআই) । এই সিপিআই সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ১৩৩তম। পাকিস্তানকে একটি ‘অনিরাপদ রাষ্ট্র’ও বলা হয়। পরিভাষা দিয়েই সহজে অর্থ অনুধাবন করা সম্ভব। এই অনিরাপদ রাষ্ট্র হলো এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে সে দেশের নাগরিকসহ অন্যান্য সবার জন্য একটা অনিরাপদ পরিবেশ বিরাজ করছে। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক শান্তি সূচকে সেটির স্পষ্ট প্রামাণ লক্ষ্য করা যায়। এই শান্তি সূচকে দুই ধাপ উন্নয়ন করেও পাকিস্তানের অবস্থান ১৪০। সেখানে আট ধাপ কমেও বাংলাদেশের অবস্থান ৯৩। এদিকে ‘ক্লাইন্ট রাষ্ট্র’ বলতে এমন রাষ্ট্রকে বোঝায় যে রাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে অন্যের উপর নির্ভরশীল।
গত এক দশকে পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্র ও অন্তর্জাতিক সংস্থার উপর সামরিক ও আর্থিক নির্ভরশীলতা দেখে সেটি সহজেই অনুমান করা যায়। আর ‘ফারাইয়া রাষ্ট্র’ বলতে সেই সব রাষ্ট্রকে বোঝায় যে রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে বিচ্ছিন্ন বা অগ্রহণযোগ্য। আর ‘রগ’ বা ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ বলতে এমন একটি রাষ্ট্রকে বোঝায় যে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য একটা বড় বাঁধা বা হুমকি। আর ‘সেমি ব্যর্থ’ ও ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ বলতে প্রায় কাছাকাছি এক ধরণের রাষ্ট্রকে বোঝায় যে রাষ্ট্র দেশে আইনের সমতা প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা ও সেবা প্রদানে ব্যর্থ।
বর্তমানে চলমান আন্দোলন ও সামাজিক পরিস্থিতির অবনতি দেখে সেটাও আঁচ করা যায়। এই পরিভাষাগুলোর অর্থ ভিন্ন হলেও সেগুলোর মধ্যে একধরণের মিল আছে। তাহলো যে রাষ্ট্র এই বৈশিষ্ট্য ধারণ করে সেটি বন্ধুহীন, অস্থিতিশীল, অকার্যকর ও অনিরাপদ। সেক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্র যদি এই ধরণের রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় তাহলে তা হবে আত্মঘাতীমূলক ও অনিরাপদ একটি সম্পর্ক। সেখানে নতুন বন্ধু রাষ্ট্রের লাভের চেয়ে নানান ঝুঁকির আশঙ্কা বেশি।
এ কথা সত্য যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ‘স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু’ বলে কোনো কথা নেই। তাই একটি রাষ্ট্র অন্য একটি রাষ্ট্রকে বন্ধু বানানোর পূর্বে কৌশলী হতে হয়। সার্বিক বিষয়ে ভাবতে হয়। আর এই ধরণের রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে যেহেতু ঝুঁকির পরিমাণ বেশি তাই এগোতে হয় ধীরে ও অতি সাবধানে। সেক্ষেত্রে কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির প্রাক্কালে সেই সম্পর্কের ঝুঁকি ও সম্ভাবনা কতটুকু কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে সেটি অনুমান করা যায়। তাহলো ওই দেশের সঙ্গে তার প্রতিবেশীর সম্পর্ক কেমন। ওই দেশের অন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু। ওই দেশের বন্ধু কে এবং শত্রু কে। এই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। এটাও বোঝা যায় যে ওই দেশের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি করলে সেই জাতিগোষ্ঠীকে পরবর্তীতে কোন কোন কূটনৈতিক জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে।
ভৌগোলিক পরিধির বিবেচনায় পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ প্রতিবেশী হলো ভারত ও আফগানিস্তান। তারপরেই রয়েছে ইরান। আমরা যদি পাকিস্তানের সঙ্গে তার প্রতিবেশীদের সম্পর্কের দিকটা দেখি, সেখানে দেখা যাবে যে এই তিন প্রতিবেশীর কারো সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নেই দেশটির। বরং বলা চলে তিন বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কটা সাপে-নেউলে। ভারতের সঙ্গে একটা ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব তো আছে। তার সঙ্গে বর্তমান আফগানিস্তানের সঙ্গেও পাকিস্তানের সম্পর্ক অত্যন্ত শত্রুভাবাপন্ন। ওদিকে এই বছরের শুরুতেই অর্থাৎ মধ্য জানুয়ারি মাসেই ইরান পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে হামলা চালায়। পাল্টা জবাব হিসেবে পাকিস্তানও ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তানে হামলা চালায়। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ‘সুন্নি-শিয়া’ ছায়াযুদ্ধ মনে করলেও এই যুদ্ধের ফলে পকিস্তানের তার তৃতীয় বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গেও ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সম্পর্কে পৌঁছে গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হলে ভারতের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত একটা সুবিধা আছে। কিন্তু তা বহুলাংশে লাভের চেয়ে ঝুঁকির পরিমাণ বাড়াবে। কারণ এই চাপ প্রশমনে ভারতও তার পাল্টা ব্যবস্থা নিতে চাইবে। আবার ভারতের যেহেতু ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ অর্থাৎ ইরান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো সেটা আমাদের জন্য আঞ্চলিক রাজনৈতিক বলয়ে আরও কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে এই ধরণের সম্পর্ক তৈরির প্রাক্কালে আমাদের দশবার ভাবতে হবে। ভেবে দেখতে হবে যে আমাদের মত দেশ কী সেই ধরণের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় সরাসরি অংশগ্রহণে সক্ষম কিনা। সেই হিসেবে ভুল হলে ফলাফল শুভ হবে না।
পাঁচই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পরে সামাজিক মাধ্যমে থেকে শুরু করে বর্তমান সরকারের মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির একটা আলোড়ন তৈরি হয়েছে। সঙ্গে পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও নানাভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিনির্মাণের একটা আকাঙ্ক্ষা দেখা যাচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে পাকিস্তানের মত একটা বন্ধুস্বপ্ল বা আন্তর্জাতিক পরিসরে মোটামুটি অজনপ্রিয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নতুন বন্ধু তৈরির এই প্রচেষ্টা অত্যন্ত স্বভাবিক। কিন্তু আমাদের যেহেতু এখন তুলনামূলকভাবে আরও বড় পরিসরে সম্পর্ক তৈরির সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। আমাদের এও মনে রাখতে হবে যে আমরা সম্পর্ক তৈরি করলেই পাকিস্তানের সঙ্গে অন্য দেশের নীতি বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে না। বরং এই সম্পর্ক বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে আরও চ্যলেঞ্জের সম্মুখীন করতে পারে।
এছাড়াও একটা দেশের সঙ্গে গভীর সখ্য তৈরি হলে দুই দেশের মধ্যে শুধু যে অর্থনৈতিক, সামরিক বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধার আদান প্রদান হয় তা নয়। সে দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে আরও অনেক অরাজনৈতিক বিষয়ের আদান-প্রদানও হয়। ফলে বন্ধু দেশের মধ্যে সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে সেদেশের সংকটের আদান-প্রদানও অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের কথা বলা যায়। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে এই আর্থিক সম্পর্ক তৈরিতে আমরা আর্থিকভাবে অনেক লাভবান হয়েছি। তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক ও নীতিগত উদাসীনতার কারণে আমাদের সাংস্কৃতিক অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক রেমিট্যান্সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে সেখান থেকে সামজিক ও সাংস্কৃতিক রেমিট্যান্সও প্রবেশ করেছে। একইভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক হলে সেখানকার ‘উগ্র ধর্মবাদ’ আমাদের দেশে প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কা থেকে যায়। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট’-এর প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় জঙ্গী অর্থায়নের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ হলো পাকিস্তান। যেটা আমাদের মত আর্থিক সক্ষমতার দেশের ক্ষেত্রে অনেক ভয়ঙ্কর হতে পারে। একই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালে পাকিস্তানে জঙ্গী হামলার হুমকি বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে। সেটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
সর্বশেষ বলা যায় পাকিস্তানকে বাঙালি সংস্কৃতির ‘ঐতিহাসিক শত্রু’ হিসেবে না মানলেও ঐতিহাসিক কারণেই তাদের সঙ্গে এদেশের জনগোষ্ঠীর স্যামুয়েল হান্টিংটনের ভাষায় বললে ‘এ্যন্ডিউরিং এনমিটি’ বা ‘স্থায়ী বা চলমান শত্রুতা’ বজায় রয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের গণহত্যার কারণে বাংলাদেশের জনগণের মানসপটে ঐতিহাসিক যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়ে আছে, সেই ক্ষত মিলিয়ে দেওয়াও সম্ভব নয়। সূত্র: বিডি নিউজ ২৪।
আপনার মতামত জানানঃ