এলএনজি ও জ্বালানি তেল আমদানিতে বকেয়ার পরিমাণ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন (১২০ কোটি) ডলার ছাড়িয়েছে। বর্তমান বিনিময় হারে প্রতি ডলারে ১১৮ টাকা ধরে বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এলএনজিতে জুলাই পর্যন্ত বকেয়ার পরিমাণ ৭০০ মিলিয়ন (৭০ কোটি) ডলার। জ্বালানি তেলে বকেয়া ৫০০ মিলিয়ন (৫০ কোটি) ডলারের বেশি। বিপুল এ বকেয়া পরিশোধে জ্বালানি বিভাগকে চাপ দিচ্ছে সরবরাহকারীরা। সূত্র: বণিক বার্তা।
জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত ডলারের সংস্থান না থাকায় জ্বালানি আমদানি বাবদ বকেয়া বেড়ে চলেছে। দ্রুত তা পরিশোধ না হলে জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে ঝুঁকিতে পড়তে পারে বাংলাদেশ। তবে অর্থ বিভাগ থেকে নিয়মিত বিল পরিশোধের বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে এ ঝুঁকি অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যাবে।
বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে জ্বালানি বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ও স্পট মার্কেট এলএনজি আমদানি এবং দেশে গ্যাস উত্তোলনকারী বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইওসি) পাওনা চলতি মাস পর্যন্ত বকেয়া পড়েছে ৭০০ মিলিয়ন ডলার। আর পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে বকেয়া রয়েছে ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তিনি বলেন, ‘এ বকেয়া পরিশোধে সরবরাহকারীদের দিক থেকে এক ধরনের চাপ রয়েছে। তবে অর্থ বিভাগ থেকে নিয়মিত অর্থ পেলে এ জটিলতা থাকবে না বলে আশা করি। সরবরাহকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তারা আমদানি ও বিল পরিশোধ নিয়মিত রাখলে কোনো ধরনের অসুবিধা নেই বলে জানিয়েছে।’
দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল আমদানিতে সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর পাওনা বকেয়া ২০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক মাসে তা বেড়ে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
সরবরাহকারীদের বকেয়া পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংকে দফায় দফায় বৈঠক করেছে জ্বালানি বিভাগ। ডলারের প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে কয়েক দফা চিঠি দেয়া হলেও মুদ্রাটির সংস্থান হচ্ছে না। সরবরাহকারীদের বিলম্বিত বিল দ্রুত পরিশোধ করা না গেলে জ্বালানি সংকট তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান বিপিসির কর্মকর্তারা।
দেশে জ্বালানি তেল আমদানি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। সংস্থাটি সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রতি মাসে ১৭-১৮টি এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়। এসব এলসি দায় মেটাতে প্রতি মাসে গড়ে খরচ হয় ৪৫০-৫০০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে গড়ে ৩৫০-৪০০ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যায়। ফলে বাকি অর্থ বকেয়া থেকে যায়, যা পরিশোধে ৩০-৪৫ দিন সময় লাগে।
দেশে গত মাসের মাঝামাঝি থেকে চলতি মাসের ১০ আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রমে বেশ ব্যাঘাত ঘটেছে। এ সময় জ্বালানি তেল আমদানি কার্যক্রম চালু থাকলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে সরবরাহ কার্যত বন্ধ ছিল। সরবরাহকারীদের অর্থও পরিশোধ করা যায়নি।
বিপিসি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫৯ লাখ ১০ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ৩০ লাখ ৮০ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল জিটুজি চুক্তির আওতায় এবং ২৮ লাখ ৩০ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আমদানির কথা রয়েছে। এর বাইরে ১৪ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিপিসি।
দেশে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে ২০১৮ সাল থেকে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে কাতার ও ওমান থেকে এবং স্পট মার্কেট থেকে নিয়মিত কেনা হচ্ছে গ্যাস। এছাড়া দেশে গ্যাস উত্তোলনকারী বিদেশী প্রতিষ্ঠানের (আইওসি) কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া পড়েছে। সব মিলিয়ে গ্যাস খাতে মোট বকেয়া ৭০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্যাসের আমদানি প্রক্রিয়ায় বকেয়ার বিষয়টি চলমান। তবে গত দুই মাসে বকেয়া আগের চেয়ে বেড়েছে। গ্যাস আমদানিতে পেট্রোবাংলার অর্থ নিয়মিত ছাড় হওয়া প্রয়োজন। বিশেষত শিল্পে ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে এ বকেয়া কমিয়ে আনা জরুরি। অর্থ বিভাগের সঙ্গে বকেয়ার বিষয়টি নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।’
বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে স্থানীয় পর্যায়ে দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলোর উত্তোলিত গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুট। পাশাপাশি এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে প্রায় ৬০ কোটি ঘনফুট। একটি এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় সক্ষমতার তুলনায় গ্যাস সরবরাহ কম হচ্ছে ৫০ কোটি ঘনফুট। এটি গ্রিডে আবার যুক্ত হলে এলএনজি আমদানি বাবদ অর্থ পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘জ্বালানি তেল ও গ্যাস দেশের অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় এটার ঘাটতি হওয়া মানেই বড় সংকট তৈরি হওয়া। সরকারকে জ্বালানি নিরাপত্তার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়েই সামনে এগোতে হবে। কারণ এগুলোর সঙ্গে জনস্বার্থ গভীরভাবে জড়িত। সেই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ এ অর্থ কেন বকেয়া হলো তা এখন দেখা দরকার। কারণ সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো অর্থ না পেলে তেল-গ্যাস রফতানি কমিয়ে দিতে পারে। তাতে দেশে সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
আপনার মতামত জানানঃ