বাড়িওয়ালাদের লাগাম টেনে ধরার জন্য করোনা আসার আগ থেকেই চলছিল জল্পনা কল্পনা। বিভিন্ন মহল থেকে জানানো হয়েছিল দাবি প্রতিবাদ। করোনাভাইরাসের সক্রমণের কারণে মানুষ লকডাউনে পড়ে কর্মশূন্য হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ যখন খেয়ে দেয়ে বেঁচে থাকাটাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছে, সেখানে বাড়ি ভাড়া এক বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঘাড়ের ওপরে। এমতাবস্থায় আর্থিক যোগান দিতে না পারায় বাসাও ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে। ফিরে গেছেন গ্রামে। ভাড়াটিয়াদের দিনাতিপাত নিয়ে চারপাশ শঙ্কিত যেখানে, এরইমধ্যে খুলনার লবণচরা এলাকাতে বাড়ি ভাড়া আদায়কে কেন্দ্র করে এক ভয়ানক কাণ্ডের খবর পাওয়া গেলো। অগ্রিম ঘর ভাড়া না পেয়ে পাঁচদিন শিশু সন্তানসহ ভাড়াটিয়া পরিবারকে তালাবদ্ধ করে রাখে এক বাড়িওয়ালা এবং ঘর তালাবদ্ধ থাকায় বালতির পানিতে শিশু পড়ে গেলে চিকিৎসার অভাবে ছয় মাসের এক শিশুর মৃত্যু হয়। গত ১৩ জানুয়ারি খুলনার লবণচরা এলাকাতে এ ঘটনাটি ঘটে। এতে লবণচরা থানায় বাড়িওয়ালাকে অভিযুক্ত করে মামলাও করা হয়েছে।
জানা যায়, ২০২০ সালে ডিসেম্বর মাসে কাঠের ডিজাইন মিস্ত্রী ইমদাদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী তামান্না মাসে চার হাজার টাকা চুক্তিতে রিয়াবাজার এলাকায় একতলা বাড়ির দুইটি কক্ষ ভাড়া নেন। কিন্তু জানুয়ারি মাসের অগ্রিম ভাড়া দিতে না পারায় গত ৬ জানুয়ারি থেকে ঘরে শিশু সন্তানসহ তামান্নাকে তালাবদ্ধ করে রাখে বাড়িওয়ালা নওশের। এসময় তামান্নার স্বামী মোংলা ঝিউধরা এলাকায় কাঠের কাজ করছিলেন।
তামান্না ইসলাম জানান, তালাবদ্ধ অবস্থায় গত ১১ জানুয়ারি দুপুরে বাড়ির ছাদে কাপড় নাড়তে যান। শিশুটি হঠাৎ খেলতে গিয়ে বালতির পানির মধ্যে উল্টে যায়। ঘরে এসে তিনি শিশুটিকে ওই অবস্থা থেকে উদ্ধার করলেও বাইরে থেকে ঘর তালাবদ্ধ থাকায় চিকিৎসকের কাছে নিতে পারেননি। ওই অবস্থায় শিশুটির মৃত্যু হয়।পরে এলাকাবাসী তালা ভেঙে তাদের উদ্ধার করে।
স্থানীয়রা জানান, শিশুটির মা জানালা দিয়ে চিৎকার করলে আশেপাশের লোকজন তালা ভেঙ্গে তাদেরকে উদ্ধার করে। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে শিশুটি মারা যায়।
মায়ের আকুতি, আমার মতো এভাবে আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। আর কোন পাষণ্ড বাড়িওয়ালা যেন এভাবে অন্যায় করতে না পারে। এজন্য তিনি বাড়িওয়ালার বিচার দাবি করেন।
শিশু নেলিহার বাবা ইমদাদুল হক সাগর মামলায় উল্লেখ করেন, মাত্র এক মাসের ভাড়া না পেয়ে বাড়িওয়ালার বাবা নওশের আলী তাদের ঘরে ঢুকে জীবননাশের হুমকি দেন। ঘরে থাকা আসবাবপত্র ক্ষতিসাধন করে প্রধান গেটে তালা মেরে দেন। ঘর তালাবদ্ধ থাকায় শিশুটি বালতির পানিতে ডুবে গেলেও তাকে সময়মতো হাসপাতালে নেওয়া যায়নি, যা চিকিৎসার কাজে বাধা ও হত্যার শামিল। এ ব্যাপারে লবণচরা থানায় গেলে পুলিশ তাদের অভিযোগ না নিয়ে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়। পরে তারা জানতে পারেন, পুলিশ অভিযোগ গ্রহণ করেনি।
লবনচোরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সমীর কুমার সরদার জানান, শিশু মৃত্যুর ঘটনায় অভিযোগ পেয়ে প্রাথমিক তদন্তে গৃহকর্ত্রীর অসাবধানতায় শিশুটি মারা গেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। গৃহকত্রী শিশুটিকে গোসল করাতে করাতে মোবাইল ফোন আসলে তিনি কথা বলার জন্য সে অবস্থায় শিশুকে রেখে ছাদে চলে যান। এদিকে শিশুটি পাত্রের পানিতে পড়ে অচেতন হয়ে যায়। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে তার মৃত্যু হয়। তাই এ ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা করা হয়েছে।
পরে আদালত আদালত মামলাটি গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। গতকাল সোমবার(১৮ জানু) দুপুর ১২টায় মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক ড. আতিকুস সামাদ এ আদেশ দেন। মামলায় বাড়ির মালিক নূর ইসলাম ও তার বাবা নওশের আলীকে আসামি করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাড়িওয়ালাদের দৌরাত্মের লাগাম টেনে ধরতে সরকার কখনোই অতোটা আগ্রহী ছিলেন না। করোনাকালীন সময়ে বাড়িভাড়া বিষয়ে তর্ক উঠলেও সরকারের নীরবতা বাড়িওয়ালাদের রক্ষার স্বার্থেই পরিগণিত হয়েছে বলে মনে করেন তারা। করোনা মহামারিতে মানুষের আয় উপার্জন এমনিতেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। খেয়ে দেয়ে বেঁচে থাকাটাই যেখানে চ্যালেঞ্জ সেখানে বাড়ি ভাড়া ও বাড়িওয়ালাদের দৌরাত্ম গোঁদের ওপর বিষফোঁড়াই যেন। তারা মনে করেন, সরকারের উচিত বাড়ি ভাড়া ও বাড়িওয়ালা বিষয়ে জনমুখী সিদ্ধান্তে আসা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৪৬
আপনার মতামত জানানঃ