সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানীজুড়ে ছড়িয়ে পড়া নজিরবিহীন সংঘাত নিয়ন্ত্রণে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশকে (ডিএমপি)। হাজার হাজার আন্দোলনকারীর সঙ্গে পুলিশের মুখোমুখি সংঘর্ষে শুরুতেই বেকায়দায় পড়েন পুলিশ সদস্যরা। সুযোগ পেয়ে রাজধানীর পথে পথে অবরুদ্ধ করে তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়।
পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী, আন্দোলনকারীদের তুলনায় মাঠে কম সদস্য থাকায় জনগণের নিরাপত্তা তো দূরের কথা, উল্টো নিজেদের রক্ষা করতেই হিমশিম খেতে হয় তাঁদের। অভিযানে যুক্ত হওয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেন।
এই উপলব্ধি থেকে ভবিষ্যতের সহিংসতা প্রতিরোধে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে ডিএমপি। পুলিশ কর্তারা মনে করছেন, সামর্থ্য থাকার পরও শুধু সংখ্যার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ায় পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল।
ডিএমপির একটি সূত্র বলছে, পুলিশের সবচেয়ে বড় এই ইউনিটে এখন ৩২ হাজারের মতো সদস্য রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সরাসরি দাঙ্গা দমনে মাঠে কাজ করেন ১৮ থেকে ২০ হাজার। কর্মকর্তাদের শঙ্কা, ভবিষ্যতে এ ধরনের সহিংস আন্দোলন আরও বাড়তে পারে। তাই এবার আগে থেকেই পুরো পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় পুলিশ। সে জন্য দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আরও অন্তত ১০ হাজার সদস্য ঢাকায় আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, শিক্ষার্থীদের ব্যানারে জামায়াত-শিবির যে দুর্বৃত্তায়ন চালিয়েছে, তা রুখে দেওয়ার সক্ষমতা পুলিশের রয়েছে। তারপরও ইউনিটকে শক্তিশালী করতে আরও অন্তত ১০ হাজার পুলিশ সদস্য আনার সুপারিশ করার চিন্তা করা হচ্ছে।
এত সদস্য থাকার পরও হামলা-ভাঙচুর ঠেকানোসহ নিজেদের রক্ষা করতে পুলিশ ব্যর্থ হলো কেন? এ প্রশ্নে পুলিশের সাবেক প্রধান এ কে এম শহিদুল হক গতকাল বৃহস্পতিবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, রাজধানীতে একযোগে যখন আন্দোলনের নামে দুর্বৃত্তরা ছড়িয়ে পড়ে, ভাঙচুর চালায়, পুলিশের ওপরও দফায় দফায় হামলা হয়, তখন সীমিত এই পুলিশ সদস্য দিয়ে কিছু করার ছিল না। বাহিনীতে বা ইউনিটগুলোতে এত পুলিশও নেই।
কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ১৬ জুলাই থেকে তীব্র আকার ধারণ করে। ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা। একপর্যায়ে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে নামানো হয়। তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, মেট্রো রেলস্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সেতু ভবন, বিভিন্ন থানা, পুলিশ ফাঁড়িসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। সংঘাত, ভাঙচুর, আগুনে বাড়তে থাকে হতাহতের সংখ্যা। শেষ পর্যন্ত কারফিউ জারি করে নামানো হয় সেনাবাহিনী।
ঢাকার পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সহিংসতা যতক্ষণ কয়েকটি জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ততক্ষণ পুলিশের জন্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সংঘাত যখন ঢাকার বিভিন্ন অংশ ও অলিগলিতে ছড়িয়ে যায়, তখন সেটির মোকাবিলা করা পুলিশের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সহিংসতার শেষ তিন দিন রাজধানীতে অনন্ত ২১ জায়গায় একযোগে বিক্ষোভ আর ভাঙচুর শুরু হয়। প্রতিটা জায়গায় পুলিশ মোতায়েন ছিল। কিন্তু আন্দোলনকারীদের তুলনায় মাঠে পুলিশ সদস্য ছিল অনেক কম।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা এখন পুরো আন্দোলন ও সহিংসতার বিষয়টি বিশ্লেষণ করছি। আমাদের হাতে আরও ফোর্স যদি থাকত এবং তা কীভাবে মোতায়েন করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত, তা ভাবা হচ্ছে।’
ডিএমপির ৩২ হাজার পুলিশ কাঠামোর মধ্যে কীভাবে ১০ হাজার সদস্য নিজেদের ইউনিটে যোগ করা হবে—জানতে চাইলে ডিএমপির উপ-কমিশনার (অপারেশনস) মো. ইউসুফ আজকের পত্রিকাকে বলেন, বাহিনীর সব ফোর্স থাকে আইজিপির আওতায়। যদি কোনো ইউনিটে অতিরিক্ত ফোর্স প্রয়োজন হয়, তখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেরা আলোচনা করে পুলিশ সদর দপ্তরে আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইজিপি বিভিন্ন জেলা থেকে বা অতিরিক্ত ফোর্স থেকে ওই ইউনিটকে সদস্য দিতে পারেন। ডিএমপির ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য হবে।
আপনার মতামত জানানঃ