পদার্থবিদ আইজ্যাক নিউটন স্রেফ যদি বেড়াল নিয়ে গবেষণা করতেন, তবে তার পক্ষে গতির বিভিন্ন সূত্র কখনোই আবিষ্কার করা সম্ভব হতো না।
ধরা যাক, কেউ একটি বেড়ালের পেট উঁচু করে ধরে একে দোতলার জানালা থেকে ফেলে দিলেন। এক্ষেত্রে বেড়ালকে যদি শুধু একটি ‘যান্ত্রিক ব্যবস্থা’, যা নিউটনের গতিশীল পদার্থের বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলে, সে হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে মাটিতে সবার আগে পড়া উচিৎ বেড়ালটির পিঠ।
এর পরিবর্তে বেশিরভাগ বেড়াল নিচে পড়ার সময় জখম এড়াতে সাধারণত নিজেকে পুরোপুরি উল্টে ফেলে ও সবার আগে মাটিতে পড়ে এদের পা।
বেশিরভাগ মানুষই বেড়ালের এ কৌশলে বিস্মিত হন না। কারণ, প্রায় সবাই এই প্রাণীটির ‘অ্যাক্রোব্যাটিক’ দক্ষতার সঙ্গে পরিচিত বা এ সংশ্লিষ্ট নানা ভিডিও দেখেছেন। তবে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে, বেড়াল কীভাবে এমন করে তার পদার্থবিদ্যা জানা বিজ্ঞানীদের মূল আগ্রহের জায়গা।
বেড়াল যদি প্রাণহীন হতো আর এর দেহের ভর ও আকার একইরকম থাকত, তাহলে সে বেড়াল কখনোই জ্যান্ত বেড়ালের মতো মাটিতে পড়ত না। বেড়াল যেন পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাটিতে পড়ে। আর এটিই সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন নোবেল বিজয়ী ফ্রাঙ্ক উইলচেক।
তবুও পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন সূত্র বেড়ালের পাশাপাশি পোকামাকড় থেকে শুরু করে হাতি পর্যন্ত সব ধরনের প্রাণীর বেলায় প্রযোজ্য। পদার্থবিদ্যার সঙ্গে জীববিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই, বরং আলিঙ্গন করে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে প্রযুক্তি সাইট আর্স টেকনিকা।
আণুবীক্ষণিক স্কেলে ঘর্ষণ থেকে পানি ও বাতাসের তরল গতিবিদ্যা, সবক্ষেত্রেই প্রাণীরা পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, প্রাণীদের দৌড়ানো, সাঁতার কাঁটা বা ওড়ার মতো কাজগুলো।
এমনকি প্রাণীদের আচরণের অন্যান্য দিক, যেমন শ্বাস নেওয়া থেকে বাসস্থান তৈরি, এক্ষেত্রেও পদার্থবিজ্ঞানের আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধ ও সুবিধার ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভর করতে হয়।
“জীবন্ত প্রাণীরা আসলে… বিভিন্ন এমন সিস্টেম, যাদের বিভিন্ন কাজ একাধিক দৈর্ঘ্য ও সময়ের পরিসরজুড়ে পদার্থবিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ,” ‘কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স’-এর বার্ষিক পর্যালোচনার সাম্প্রতিক সংখ্যায় লিখেছেন জেনিফার রিসার ও সহ-লেখকরা।
প্রাণীদের আচরণের পদার্থবিদ্যা এখনও শৈশবকালে থাকলেও এদের বিভিন্ন স্বতন্ত্র আচরণ ব্যাখ্যায় যথেষ্ট অগ্রগতি দেখা গেছে। এ ছাড়া, অন্যান্য প্রাণী ও পরিবেশের সঙ্গে এমন আচরণ কীভাবে কাজ করে, সেটিও বোঝা যায় এর মাধ্যমে।
প্রাণীদের আচরণের বেশ কিছু বিস্তৃত পরিসরে পদার্থবিদ্যার ভূমিকা আছে। এর একটি হল, টিকটিকি জাতীয় সরিসৃপ ও পোকামাকড়ের দেয়াল বেয়ে ওঠা এমনকি সিলিং দিয়ে সহজে হাঁটার সক্ষমতা।
রিসার ও তার সহকর্মীরা বলছেন, অন্যান্য জৈবিক করসতের ক্ষেত্রে কাজ করে এর চেয়ে কিছুটা বড় পরিসর, গঠন ও কাঠামো। এর উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, পাখির পালকে থাকা ছোট ছোট হুক ও কাঁটা অনেকটা ভেলক্রো বা জিপারের মতো কাজ করে, যা তাদের ওড়ার কাজটি সহজ করে দেয়।
এ ছাড়া, প্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অংশ ও এদের চামড়ায় ঘর্ষণ সৃষ্টি করা নানা গঠন প্রক্রিয়া প্রাণীর গতিবিধিতে সহায়তা করে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, ‘ক্যালিফোর্নিয়া কিং’ প্রজাতির সাপের বিভিন্ন আশে এমন উঁচুনিচু নকশা দেখা যায়, যা এদের দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। তবে এই ঘর্ষণ পেছন বা পাশ থেকে এলে সাপের গতিবিধিও বদলে যেতে পারে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় ইঙ্গিত মিলেছে, কিছু কিছু ‘সাইডওয়াইন্ডিং’ সাপ দৃশ্যত বিভিন্ন এমন টেক্সচার থেকে বিবর্তিত হয়েছে, যেগুলো সামনে এগিয়ে গেলে এদের ঘর্ষণ কমে যায়।
এদিকে, পানিতে প্রাণীদের গতিবিধির ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের ছোট কাঠামো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বেশিরভাগ প্রাণীর বেলায়, ছোট ছোট কাঠামো এদের দেহকে ‘সুপারহাইড্রোফোবিক’ করে তোলে, যা এদের শরীরে পানির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে সক্ষম।
“আর্দ্র জলবায়ুতে পাখি ও পোকামাকড়ের মতো প্রাণীদের দেহে পানির ফোঁটা পড়া অপরিহার্য, যা তাদের ওজন ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” বলেছেন ‘ইমোরি ইউনিভার্সিটি’র রিসার ও এই গবেষণার সহ-লেখক চ্যান্টাল এনগুয়েন, ওরিট পেলেগ ও ক্যালভিন রিস্কা।
এ ছাড়া, পানিকে আটকে দেয় এমন পৃষ্ঠও বিভিন্ন প্রাণীর ত্বক পরিষ্কার রাখতে সহায়তা করে।
“এই সেলফ-ক্লিনজিং প্রক্রিয়া… ত্বকবাহিত পরজীবী ও অন্যান্য সংক্রমণ থেকে প্রাণীদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।”
এমনকি কিছু ক্ষেত্রে, কোনো প্রাণীর চামড়া থেকে বিভিন্ন বহিরাগত উপাদান সরানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে চামড়ার এমন বৈশিষ্ট্য, যা এদের ছদ্মবেশ ধারণের ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়।
আলো কীভাবে কোনও প্রাণীর চামড়ায় প্রতিফলন ঘটায়, সেটির ব্যাখ্যাও রয়েছে পদার্থবিদ্যায়। পাখি, প্রজাপতি ও কিছু পোকামাকড়ের উজ্জ্বল রঙের বিষয়টি নির্ভর করে বিভিন্ন স্তরের ক্ষুদ্র কাঠামো কীভাবে সমন্বিত হয়, তার ওপর। এ ধরনের রং ‘কোর্টিং’ নামের এক প্রক্রিয়ায় অবদান রাখার পাশাপাশি এদের শিকারী এড়ানোর সক্ষমতাতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ