পেট্রোল ও অকটেন দুটোই গাড়ির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে পেট্রোলের তুলনায় অকটেন গাড়ির ইঞ্জিন বেশি ভালো রাখে। দেশে অকটেনের চাহিদা মেটাতে বড় অংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এজন্য দামও পড়ে বেশি। অথচ পেট্রোলকে অকটেনে রূপান্তর করতে পারলে যানবাহনের ইঞ্জিন ভালো থাকবে, সঙ্গে আমদানি খরচ না থাকায় কমবে অকটেনের দাম। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ২০১২ সালের মার্চ থেকে পেট্রোলকে অকটেনে রূপান্তর করতে একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ সরকার। পেট্রোবাংলার আওতায় এ প্রকল্পের দায়িত্ব পায় সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড (এসজিএফএল)। কিন্তু পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্প আট বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়িত হয়নি। বরং প্রকল্পের মেয়াদ এবং খরচ বাড়ানো হচ্ছে, কাজের কাজ তেমন একটা এগোয়নি।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, দেশকে অকটেনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে ২০১২ সালে সিলেটের রশিদপুরে ৩ হাজার ব্যারেল ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যাটালাইটিক রিফর্মিং ইউনিট নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এতে রশিদপুরের গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাওয়া কনডেনসেড পেট্রোল থেকে অকটেনে রূপান্তর করা সম্ভব হবে। এজন্য ওই বছরের মার্চে ৩৫৪ কোটি ১৩ লাখ টাকার প্রাথমিক ব্যয় ধরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে একটি প্রকল্প পাস করা হয়। সময়সীমা ধরা হয় ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু নির্ধারিত এ সময়ের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে না পারায় পরে জ্বালানি বিভাগের এক বৈঠকে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এরপর সে সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় জ্বালানি বিভাগ থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও দেশীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তোলা হয়।
এদিকে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় পুনরায় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সময় বাড়ানোর দাবি জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বর্ধিত সময়সীমা ধরা হয় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। সেই সঙ্গে প্রকল্প ব্যয় ৩৫৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা করা হয়।
ব্যয় বাড়া প্রসঙ্গে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘এ প্রকল্পের প্রথমে যে ব্যয় ধরা হয়েছিল, সে সময় এর আকার ছোট ছিল। আস্তে আস্তে প্রকল্পের আকার বড় হয়েছে, এ কারণে ব্যয়ও বেড়েছে।’
দেশে বর্তমানে বার্ষিক ১ লাখ ৩০ হাজার টনের মতো অকটেনের চাহিদা রয়েছে। আর দৈনিক চাহিদা রয়েছে ২ হাজার ৯০০ ব্যারেল। রশিদপুরে এ প্লান্ট চালু হলে তার পুরোটাই এখান থেকে পূরণ করা সম্ভব। এছাড়া দেশে বর্তমানে অকটেনের বার্ষিক বাজার প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার মতো। এ বাজারও প্রসারিত হতো এ প্লান্ট চালু হলে। তবে গত আট বছরে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ায় অকটেনের বাজার বড় হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, দেশে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ কনডেনসেড থেকে পেট্রোল, কেরোসিন ও ডিজেল তৈরি হয়। তবে রিফর্মিং করে সেটি অকটেনে রূপান্তর করা গেলে বাজারও প্রসারিত হবে। এ ধরনের প্লান্ট বাস্তবায়িত হলে আরো পরিসরে জ্বালানিকে ব্যবহার করা যাবে।
তাদের মতে, ‘পেট্রোল তো বাংলাদেশে তৈরি হয়। কিন্তু এর আর চাহিদা নেই। পেট্রোলে গাড়ি কম চলে, অকটেনে বেশি চলে। অকটেন আমাদের আমদানি করতে হয়। আমাদের পেট্রোল যেটা অতিরিক্ত আছে, সেটাকে যদি অকটেনে রূপান্তর করতে পারি, তাহলে আর আমদানি করতে হবে না। অকটেনে রূপান্তর করা গেলে অকটেন ও পেট্রল- দুটোই আমদানি থেকে রেহাই পাব।’
অকটেন ও পেট্রোলের দামের মধ্যে পার্থক্য কম থাকার বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলেন, ‘এ দুটোর দামের পার্থক্য বেশি নয়। তবে পেট্রোলের চেয়ে অকটেনের চাহিদা বেশি। আমাদের নিজস্ব যে পেট্রোল, সেটা থেকে যে অকটেন উৎপাদন হয় তার গুণগত মান ভালো নয়। এটা ৮৭ মাত্রার হওয়া উচিত। কিন্তু তা হয় না, হয় ৮৩-৮৪ মাত্রার। এটাও একটা সমস্যা। পেট্রোলটা সরাসরি বিক্রি করাও কঠিন।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেবল এই প্রকল্প নয়, সরকারের নেওয়া এমন বহু প্রকল্পই ঝুলে আছে। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ হয়েছে এমন নজির দেশে বিরল। বিভিন্ন ছাল-ছুতোয় প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো আর মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে এক শ্রেণির লোকদের পকেট ভারী হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। একইসাথে প্রশ্ন তোলেন, পাঁচ বছর মেয়াদের পরিকল্পনা নিয়ে আগানোর পরে আট বছর হয়ে গেলো, পরিকল্পনাটা কেমন হলে এমন হতে পারে? নাকি আমাদের সমস্ত পরিকল্পনাই বিভিন্ন ভুল পরিসংখ্যান ধরে করা হয় যা নির্দিষ্ট সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না? তারা মনে করেন, পরিকল্পনা কিছু ত্রুটি থাকতে পারে, কিন্তু প্রকল্প ঝুলিয়ে রেখে এক শ্রেণির পকেট মোটাতাজাকরণ করতে গিয়ে পরিকল্পনার ত্রুটিগুলো আরো বড় হয়ে যাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের প্রত্যক্ষ নজরদারির সাথে প্রকল্প বাস্তবায়নের বিলম্বের হেতু বের করে সেসবের সমাধান করতে হবে বলে দাবি জানান। কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণির দ্বারা যদি হয়ে থাকে সেবিষয়েও তদন্ত করে দেখতে হবে এবং উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে বলে জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৬
আপনার মতামত জানানঃ