হাতিরা যে বুদ্ধিমান প্রাণী এটি প্রমাণিত হয়েছে বহু আগেই। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমন এক তথ্য উঠে এসেছে প্রাণীটি সম্পর্কে যেটি রীতিমতো চমকে দেবে আপনাকে। বুনো আফ্রিকান হাতিরা সম্ভবত একে অপরকে আলাদা শব্দ ব্যবহার করে ডাকে যা অনেকটা মানুষের নামের মতোই।
ডলফিনরা সগোত্রীয় কোনো প্রাণীকে ডাকতে ওই প্রাণীটির নিজস্ব শিসের মতো শব্দ নকল করে। টিয়া পাখিদের একে অপরকে একইভাবে সম্বোধন করতে দেখা গেছে। তবে কেনিয়ার আফ্রিকান হাতিরা একে অপরকে শনাক্ত করতে সম্ভবত আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে।
নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন জার্নালে গত সোমবার প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই হাতিরা তাদের দলের অন্য কোনো হাতিকে সম্বোধন করার জন্য স্বতন্ত্র নামের মতো ডাক ব্যবহার করে।
হাতির সাধারণ বা পরিচিত ডাক হলো এক ধরনের গুরুগম্ভীর গুড় গুড় শব্দ। গবেষণা বলছে, এর আবার তিনটি ধরন আছে। দূরে বা দৃষ্টির আড়ালে থাকা হাতিদের সঙ্গে যোগাযোগে এক ধরনের ডাক ব্যবহৃত হয়। একেবারে পাশে থাকা হাতির সঙ্গে যোগাযোগে ব্যবহার করা হয় আরেক ধরনের ডাক। আবার প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী বা তরুণী হাতিরা যেসব হস্তী শাবকের যত্ন নেয় তাদের জন্য অন্য এক ধরনের ডাক ব্যবহার করে।
১৯৮৬ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কেনিয়ার এম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্ক এবং সামবারু অ্যান্ড বাফেলো স্প্রিংস ন্যাশনাল পার্কের বুনো মাদি ও বাচ্চা হাতির ৪৬৯টি ডাক রেকর্ড করে এই তিন ধরনের শব্দ বিশ্লেষণ করেন গবেষকেরা।
সমীক্ষা অনুসারে, কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল হাতিগুলিকে। তকানের আকৃতি দেখে পৃথকভাবে এদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
‘ধারণাটি ছিল যদি ডাকে একটি নামের মতো কিছু থাকে, তবে হাতিটি কাকে সম্বোধন করছে তা ডাকের শাব্দিক বৈশিষ্ট্য থেকে বের করা যাবে।’ বলেন গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক এবং নিউইয়র্কের কর্নেল ইউনিভার্সিটির পশু আচরণবিদ ও পোস্ট ডক্টরাল ফেলো মিকি পেদ্রো।
পেদ্রো সিএনএনকে জানান, আর এটা করতে গিয়েই তাঁরা আবিষ্কার করেন যাকে ডাকা হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে শব্দে পার্থক্য আছে। তারা তথ্য বিশ্লেষণ করে যাদের ডাকা হচ্ছে তাদের ২৭.৫ শতাংশকে শনাক্ত করতে পারেন।
গবেষকেরা আরও আবিষ্কার করেন যে হাতিটিকে ডাকা হচ্ছে কেবল তার কণ্ঠ অনুকরণ করে না হাতিরা। বরং দুই পক্ষের ডাক আদান-প্রদান থেকে তাঁরা আবিষ্কার করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যাকে ডাকা হচ্ছে তার করা শব্দের সঙ্গে এর খুব বেশি মিল থাকে না। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে অনুকরণটা প্রাধান্য পায় না।
এখানেই থেমে থাকেননি গবেষকেরা। তারা ১৭টি হাতির ডাকের রেকর্ড বাজান। উদ্দেশ্য যাদের ডাকা হচ্ছে তারা এটি শনাক্ত করতে পারে কিনা এবং কী প্রতিক্রিয়া দেখায় তা বোঝা। গবেষকেরা দেখেন হাতিরা তাদের লক্ষ্য করে যে ডাকটি তাতে জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখায়।
‘অর্থাৎ কোনো একটি ডাক শুনেই হাতিরা বলে দিতে পারে এটি তাকে উদ্দেশ্য করে কিনা।’ বলেন পেদ্রো।
প্রকৃতিতে বিভিন্ন প্রাণীর ডাক নিয়ে কাজ করেন ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ডেনমার্কের অধ্যাপক কোয়েন এলিমেনস। এই গবেষণার সঙ্গে অবশ্য তিনি জড়িত ছিলেন না। তবে এর ফলাফল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। কারণ বন্যপ্রাণীদের মধ্যে এভাবের নামের ব্যবহারের বিষয়টি এত দিন পর্যন্ত জানা ছিল না।’
‘কিছু প্রাণী যেমন টিয়া এবং ডলফিনের বেলায় নির্দিষ্ট প্রাণীর একটি আলাদা ডাক বা সংকেত থাকতে পারে, যা অন্যরা অনুকরণ করার চেষ্টা করে। তবে এটি মানুষের নামের মতো নয়।’ বলেন তিনি।
গবেষকেরা চূড়ান্তভাবে বের করতে পারেননি বিভিন্ন হাতি দলের কোনো হাতিকে ডাকার সময় একই নাম ব্যবহার করে কিনা। নাকি একই হাতির জন্য ভিন্ন নাম ব্যবহার করছে।
তেমনি নিশ্চিত হতে পারেননি ডাকের কোন অংশটি নাম ছিল, কারণ এর মধ্যে যে ডাকছে তার বয়স, লিঙ্গ এবং মানসিক অবস্থার মতো তথ্য রয়েছে।
পেদ্রো জানান, কীভাবে এই ডাকগুলি একটি নাম ধারণ করে এটি তিনি বের করতে চান। তেমনি নির্দিষ্ট প্রাণীর জন্য নামটা আলাদা করতে চান তিনি। আর এটা হলে অনেক ক্ষেত্রেই অনুসন্ধানের জন্য নতুন দুয়ার খুলে দেবে।
আপনার মতামত জানানঃ