জংলা গাছপালায় ভরা চারপাশ। দিনের আলোতেও পথ চলতে করে গা-ছমছম। দূর থেকে টের পাওয়ার উপায় নেই, এটি রেলস্টেশন। আশপাশের কোথাও দেখা মেলে না রেলপথের। শক্তপোক্ত লাইনের অনেক অংশই কেটে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। কোথাও আবার মাটির নিচে চাপা পড়ে মিশে গেছে জোড়া লাইনের অস্তিত্ব। ১৫ বছর ধরে পরিত্যক্ত দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মধ্যপাড়ার দেশের একমাত্র কঠিন শিলা প্রকল্প রেলস্টেশনের চেহারা এখন এমনই।
খনির উত্তোলন করা পাথর সহজে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানোর এ প্রকল্পে রেলওয়ের খরচ হয়েছে প্রায় ৭১৩ কোটি টাকা। সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও খনি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় সম্ভাবনাময় এ প্রকল্পের হয়েছে ‘অপমৃত্যু’। আর কোটি কোটি টাকার রেলের সরঞ্জাম এখন দুর্বৃত্তদের কাছে ‘মেঘ না চাইতে বৃষ্টি’।
প্রকল্পের যাত্রা
কঠিন শিলা প্রকল্পের পাথর দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছাতে প্রায় ১৩ কিলোমিটার এ রেলপথের সৃষ্টি। উদ্দেশ্য ছিল, সড়কপথের পাশাপাশি খনির ৮০ শতাংশ পাথর সহজে রেলপথের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকায় পাঠানো যায়। সরকারের বড় বড় প্রকল্পের পাথর পরিবহন এ রেলপথ দিয়ে করানোর পরিকল্পনাও ছিল প্রস্তাবনায়।
নথি পর্যালোচনা করে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের দিকে কঠিন শিলা প্রকল্পে রেলপথের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে সরকার বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে রেলপথ ও স্টেশন স্থাপন করে। মিটার ও ব্রডগেজ মিলিয়ে এ প্রকল্পে খরচ হয় ৭১৩ কোটি টাকা। কঠিন শিলা প্রকল্প আর রেলপথ বিভাগের রেষারেষিতে সম্ভাবনাময় একটি উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। শুরুতে কিছুদিন খনি থেকে মালবাহী ট্রেনে পাথর বহন করা হয়েছিল।
এ প্রকল্পে প্রথমে জমি অধিগ্রহণসহ রেলপথের সব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পেট্রোবাংলাকে প্রস্তাব দেয় রেলওয়ে। পরে রেলপথ বিভাগ এটি নিজেরা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। স্থানীয় ও বৈদেশিক মুদ্রায় এতে মোট খরচ ধরা হয় ৭১৩ কোটি ১৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। এ নিয়ে ১৯৯৪ সালের ২৭ মার্চ আন্তঃমন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়। ওই বছরের ৩১ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) এটি অনুমোদন পায়। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ এটি ১৯৯৫ সালের ২৩ মার্চ চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। ওই প্রকল্পে পার্বতীপুর-ঈশ্বরদী রেলপথের ভবানীপুর স্টেশন থেকে মধ্যপাড়া পর্যন্ত ৭৪ দশমিক ৪০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এতে লেভেল ক্রসিং, কালভার্ট, কয়েকটি সেতু, একটি স্টেশন ও এর সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত হয়।
এর আগে ১৯৮১ সালে ওই প্রকল্পের জন্য মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এটি বাস্তবায়নের তাৎক্ষণিক খরচ হিসাবে ৪৫ লাখ ৩১ হাজার ৬৬ টাকা দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে। পরে ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আন্তঃরেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে ৩ শতাংশ খরচ কেটে খনি কর্তৃপক্ষকে ৪৪ লাখ ৯১ হাজার ৬৬১ টাকা ৯৫ পয়সা ফেরত দেয় রেলওয়ে। রেলপথের কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালের শুরুর দিকে। তিনটি লেভেল ক্রসিংসহ বহু ছোট সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। মধ্যপাড়ার পলিপাড়ার প্রায় ১৪ একর জমি নিয়ে সেখানে নির্মাণ করা হয় আধুনিক দ্বিতল স্টেশন।
খনি সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে মধ্যপাড়া থেকে ৫৭ হাজার ৯৩১ টন পাথর শুধু রাজশাহী ও চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। এর পর থেকে ওই রেলপথে আর কোনো পাথর নেওয়া হয়নি। অথচ রেলপথে পাথর পরিবহনে প্রতি টনে খরচ পড়ে মাত্র ৬০০ টাকা। সড়কপথে ওই পরিমাণ পাথর পরিবহন করতে লাগে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। এই হিসাব ধরা হয় মধ্যপাড়া থেকে ঢাকার দূরত্বে।
অন্যদিকে, রেলপথ থাকার পরও পাথর পরিবহন না করায় সরকারের এককালীন মোটা অঙ্কের টাকার অপচয় এবং অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। বেসরকারিভাবে ক্রেতারা সড়কপথে খনি থেকে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিন হাজার টন পাথর নিয়ে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে।
নামে লিজ, আদতে দখল
২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছর ক্ষমতাসীন দলের নেতা পরিচয়ে সাজ্জাদ হোসেন রুবেল স্টেশন এলাকা দখলে নিয়ে চাষবাস শুরু করেন। তাঁর দাপটে সেখানকার জমিদাতা ও স্থানীয় বাসিন্দা টুঁ শব্দ করার সাহস পেতেন না। সম্প্রতি দখল ছেড়ে রুবেল চলে যান দিনাজপুরে। এখন মাজহারুল হক, মাফিজুল, সিদ্দিক, মাহবুল, আঙ্গুর ও বৈদুল নামে কয়েকজনের দখলে রয়েছে স্টেশনটি। তারা সবাই নিজেদের আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করেন। তারা বিভিন্ন ফলদ ও বনজ বাগান করে স্টেশন দখলে রেখেছেন। তবে পার্বতীপুরের হরিরামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহাবুদ্দিন বলেন, পরিচয়দানকারী ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই। তারা নিজে থেকে দলের নাম ব্যবহার করছেন।
ওই রেলস্টেশন ঘিরে এলাকাবাসীর রয়েছে দুঃখগাথা। স্টেশনটির অবস্থান মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্পের অদূরে পলিপাড়া এলাকায়। বাসিন্দারা জানান, যন্ত্র দিয়ে রেললাইন কেটে নিয়ে বাজারে বিক্রি করা হয়। তবে রেল কর্তৃপক্ষ কখনও সরকারি এ সম্পত্তির খোঁজ নেয় না।
গ্রামবাসীর ভাষ্য, দীর্ঘদিন ওই রেলপথ পরিত্যক্ত থাকার সুযোগ নেয় দুর্বৃত্তরা। গত আগস্টে পার্বতীপুর-মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্পের রেলপথের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অংশের লাইন কেটে নেওয়া হয়। মধ্যপাড়া স্টকইয়ার্ড, কাঞ্চনা, নয়াপাড়া-ডাঙ্গাপাড়া-আদিবাসীপাড়া ও পলিপাড়া এলাকা থেকেও লাইন কাটা হয়। বিভিন্ন সময় লাইন চুরির ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০ থেকে ১২টি মামলা হয়েছে। শুধু সরঞ্জাম চুরি নয়, রেলের অবকাঠামো ও সেখানকার জমি স্থানীয় লোকজন কবজা করে নিয়েছে। তৈরি করেছে ঘরবাড়ি। কেটে ফেলেছে রেলের জমিতে থাকা গাছপালা।
খনি ও রেলওয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, খনির সীমানায় রেলপথ দেখভালের দায়িত্ব খনি কর্তৃপক্ষের, আর বাইরের অংশের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষের। অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে কোটি টাকার সম্পদ চুরি হয়ে গেলেও কেউ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
বর্তমানে স্টেশনটির লিজ দাবি করেন রেলওয়ের সাবেক কর্মকর্তা রওশন আরা বেগম। তিনি মধ্যপাড়ার স্থানীয় সাতজনকে দেখভাল করার দায়িত্ব দিয়েছেন বলে জানান। তাদের মধ্যে মাজহারুল হক নামে একজন বলেন, লিজ সূত্রে স্টেশনটির দায়িত্ব এখন রেলের সাবেক কর্মকর্তা রওশন আরার। আমরা সাতজন ভাগ করে এ এলাকার বাগান, জমি, পুকুরসহ সবকিছু দেখাশোনা করি।
নষ্ট শতকোটি টাকার সম্পদ
সরেজমিন দেখা গেছে, দেখভাল না করায় রেলপথে ধরেছে মরিচা। কাঠের স্লিপার পচে নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও খুলে গেছে নাটবোল্ট, কোথাও চুরি হয়ে গেছে স্লিপার। রেলপথের বড় একটি অংশ কেটে নেওয়ায় দেখলে মনে হয় না সেখানে কখনও লাইন ছিল। খনিসংলগ্ন এলাকায় পাথর লোডিংয়ের একমাত্র দ্বিতল ভবনের স্টেশনটিও এখন দুর্বৃত্তদের ‘আস্তানা’। দরজা তালাবন্ধ থাকলেও পেছনে জানালার গ্রিল কাটা। সেখানে দিনরাত নানা অনৈতিক কাজ চলে। পাথর পরিবহনের জন্য বিশাল রেলওয়ে লোডিং পয়েন্ট নির্মাণ করা হলেও তা এখন পরিত্যক্ত। স্টেশনটিতে একটি ডাবলগেজ ও চারটি সিঙ্গেলগেজ লাইন রয়েছে। তবে সবই এখন পরিত্যক্ত।
কোটি কোটি টাকার সম্পদ চুরি
বিশাল এ এলাকায় প্রতিনিয়ত চুরির ঘটনা ঘটছে। মৌলভীরডাঙ্গা এলাকা থেকে ৮ ফুট দৈর্ঘ্যের ৪৬টি রেলপাত উদ্ধার করা হয়, যার ওজন ছিল প্রায় পাঁচ টন। চুরি তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, আদিবাসীপাড়া ছাড়াও এর আশপাশে প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকায় কোনো রেলপথই নেই। বিভিন্ন সময় এ লাইন চুরি করা হয়েছে। অভিযানে বেশ কিছু চোরাই মালপত্র উদ্ধার হলেও লাইন কাটা চক্রকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ ও রেল বিভাগ কর্তৃপক্ষ।
পার্বতীপুর রেল থানার ওসি শাকিউল আযম বলেন, ‘চুরির ঘটনায় ১০ থেকে ১২টি মামলা হলেও সব আসামি অজ্ঞাত। পুলিশ সব সময় সজাগ থাকলেও চোরের দল আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। একটি লাইন কেটে নিয়ে যেতে তাদের ১৫ মিনিট লাগে। এখন পুলিশ তৎপর বলেই নতুন করে লাইন চুরির ঘটনা আর ঘটছে না।’
রেল কর্তৃপক্ষ যা বলছে
পার্বতীপুর রেলওয়ের সহকারী প্রকৌশলী রাকিব হাসান বলেন, দীর্ঘদিন পাথর পরিবহন না হওয়ায় রেলপথটি এখন পরিত্যক্ত। রেলপথ দেখভালের জন্য রেলওয়ের পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর (পিডব্লিউআই) দায়িত্বে আছেন। সেখানে রাতে পাহারা অব্যাহত আছে। সংস্কার করে রেলপথটি চলাচলের উপযোগী করা যাবে। এ জন্য সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে ৬৮ কোটি টাকা। এ কাজের প্রস্তাবনা রেল ভবনে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি অনুমোদন হলে কাজ শুরু হবে।
রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (পথ) আল আমিন বলেন, এমনিতেই রেলে জনবল সংকট। রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জনবলের চাহিদা দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। জনবল ছাড়া এই দীর্ঘ রেলপথ পাহারা দিয়ে রাখাও কষ্টকর।
এদিকে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু দাউদ মুহম্মদ ফরিদুজ্জামান বলেন, রেললাইন সংস্কারের জন্য রেলপথ বিভাগকে বহুবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। লাইনটি সংস্কার হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের নানা প্রান্তে পাথর পাঠানো যাবে। বর্তমানে এ খনি থেকে সড়কপথেই পাথর যাচ্ছে বিভিন্ন জেলায়।
আপনার মতামত জানানঃ