একটি ব্রিগেড ছাড়া দক্ষিণ গাজা উপত্যকা থেকে সমস্ত স্থল সেনা প্রত্যাহার করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। রোববার এক সামরিক মুখপাত্র এ কথা বলেছেন। খবর রয়টার্স।
তবে সামরিক বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে বিস্তারিত জানায়নি। প্রত্যাহারের ফলে দক্ষিণ গাজার রাফা শহরে দীর্ঘ হুমকির প্রতিকার হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। কারণ হামাসকে নির্মূল করতে সব ধরনের অভিযান চালানোর হুমকি দিয়েছিল ইসরায়েল।
যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে একটি নতুন দফা আলোচনার আয়োজন করেছিল মিসর। এমন সময় সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হলো।
গত ৭ অক্টোবর থেকে অবরুদ্ধ গাজায় অভিযান চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। এরমধ্যে গত কয়েক মাস ধরে শুধু দক্ষিণ গাজাতেই মূল ফোকাস ছিল ইসরায়েলি বাহিনীর।
মিশরের রাফা সীমান্ত ছিল দশ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিদের জন্য শেষ আশ্রয়স্থল। ইসরায়েলের তথ্য মতে, ৭ অক্টোবরের হামলার সময় ২৫০ জনের বেশি জিম্মি করা হয়েছিল এবং প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়েছিল।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় ৩৩ হাজার ১০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
‘যুদ্ধ শেষ হয়নি’
লেফটেন্যান্ট কর্নেল লার্নার বলেন, খান ইউনিসে সামরিক বাহিনী তার মিশন সম্পন্ন করেছে বলে সৈন্যদের সরানো হচ্ছে।
খান ইউনিস কয়েক মাস ধরে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ চলেছে। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছে শহর এবং আশেপাশের এলাকা।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল লার্নার বলেন: “যুদ্ধ শেষ হয়নি। যুদ্ধ তখনই শেষ হতে পারে যখন তারা (জিম্মি) বাড়ি ফিরে আসবে এবং হামাস নিঃশেষ হয়ে যাবে।”
“এতে বাহিনীর উপস্থিত হ্রাস পেলো ঠিকই, তবে আরও অনেক অভিযান পরিচালনা করার আছে। রাফাহ স্পষ্টতই একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। যেখানেই থাকুক, হামাসের সক্ষমতা ধ্বংস করতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন কিরবি বলেছেন, এটি একটি “রেস্ট অ্যান্ড রিফিট” (বিশ্রাম এবং পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠা) বলে মনে হচ্ছে। এবং “নিশ্চিত করে বলা যায় না যে… এই সৈন্যদের দিয়ে নতুন কোনো অভিযানের পরিকল্পনা করা হচ্ছে”।
কিন্তু পরে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেন, সৈন্যরা তাদের “ফলোআপ মিশন”- এর জন্য প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, খান ইউনিসে তাদের কৃতিত্ব ছিল “অনন্য”। “এর ফলে গাজা জুড়ে একটি সামরিক সংগঠন হিসেবে কাজ করা বন্ধ করে দিতে হয়েছে হামাসকে,” যোগ করেন তিনি।
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহ শহরে একটি পরিকল্পিত স্থল আক্রমণের হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছিল। রাফাহতে দশ লাখেরও বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছেন।
কিন্তু যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং শক্তিশালী মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সপ্তাহের শুরুতে কিছু সতর্কবার্তাও দিয়েছে।
বলেছে, গাজা যুদ্ধের জন্য তাদের চলমান সমর্থন ত্রাণ বিতরণ বৃদ্ধি এবং বেসামরিক মৃত্যু রোধে ইসরায়েল কী পদক্ষেপ নেয় তার ওপর নির্ভর করবে।
যুদ্ধের ছয় মাস উপলক্ষ্যে দেয়া বক্তব্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু’র দাবি, ইসরায়েল “জয় থেকে এক ধাপ দূরে”। কিন্তু ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি ছাড়া যুদ্ধবিরতি হবে না বলে মন্তব্য তার।
“যুদ্ধের সাফল্য উল্লেখ করার মতো। আমরা সিনিয়র কমান্ডার সহ হামাসের ২৪ ব্যাটালিয়নের মধ্যে ১৯ টিকে নির্মূল করেছি,” মি. নেতানিয়াহু বলছিলেন।
শনিবার হাজার হাজার ইসরায়েলি গাজায় আটক জিম্মিদের মুক্ত করতে চুক্তি করার দাবিতে মি. নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে সমাবেশ করেছেন।
শনিবার ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জিম্মি ইলাদ কাতজিরের মৃতদেহ উদ্ধার করে। এর কয়েক ঘণ্টা পর তেল আবিব এবং অন্যান্য শহরে মিছিল হয়েছে।
আয়োজকরা জানান, তেল আবিবের বিক্ষোভে এক লাখ লোক সমবেত হয়েছিলেন। তবে, অন্যান্য হিসাব অনুযায়ী উপস্থিতি ছিল প্রায় ৪৫ হাজার।
স্থানীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারীরা ‘এখনই নির্বাচন’ এবং ‘ইলাদ, আমরা দুঃখিত’ বলে স্লোগান দিচ্ছিলো। পরে পুলিশ জোরপূর্বক তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
ইসরায়েলি আগ্রাসনে ৬ মাসে নিহত ৩৩৬৩৪
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের ছয় মাস পূর্ণ হয়ে আজ সাত মাসে পড়লো। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের ঝুলিতে কোনো অর্জন যোগ হয়নি, কেবল ফিলিস্তিনিরা নিহত হয়েছেন, ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। আর ইসরায়েল তার ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সমর্থন হারাতে বসেছে।
এদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তাদের ৬০৪ জন সেনার প্রাণ গেছে। গতকাল ৭ এপ্রিল ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার দিনেই দক্ষিণ গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল।
দীর্ঘ ছয় মাসে উপত্যকাটিতে ক্রমাগত বেড়েছে মৃত্যুর মিছিল। ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৪৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ছয় মাসে গাজায় ৩৩ হাজার ১৭৫ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ১৩ হাজার ৮০০ জন শিশু। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ। আর পশ্চিম তীরে ৪৫৯ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এর মধ্যে ১১৭ জন শিশু রয়েছে।
দুর্ভিক্ষের মুখে প্রায় ছয় লাখ ফিলিস্তিনি। ১৭ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্ত্যুচ্যুত। আবাসিক এলাকাগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, রাস্তাঘাট ধ্বংসস্তূপে জমে আটকে গিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস হয়েছে ও কৃষিজমিগুলো এবড়ো থেবড়ো হয়ে আছে।
স্যাটেলাইট তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজার ৫৬ শতাংশের বেশি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের মধ্যেই দক্ষিণ গাজা থেকে একটি ব্রিগেড ছাড়া সমস্ত স্থল সেনা প্রত্যাহার করেছে ইসরায়েল। যদিও সামরিক বাহিনী তাত্ক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানায়নি। সেনা প্রত্যাহারের ফলে দক্ষিণ গাজার রাফা শহরে দীর্ঘ হুমকির প্রতিকার হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
আপনার মতামত জানানঃ