সংখ্যাতত্ত্বকে বলা হয় গণিতের প্রাণ। আর সংখ্যাতত্ত্বের প্রাণ মৌলিক সংখ্যাগুলো। ইংরেজিতে এদের ডাকা হয় প্রাইম নম্বর (Prime Numbers)। ‘মৌলিক’ শব্দটির প্রকৃতি হলো মূল। সংখ্যাগুলো আসলেই মূল হিসেবে কাজ করে।
সহজ কথায়, কোনো সংখ্যাকে যদি সেই সংখ্যা এবং ছাড়া অন্য কোনো সংখ্যা দিয়ে নিঃশেষে ভাগ করা না যায়, তবে ওই সংখ্যাকে মৌলিক সংখ্যা বা প্রাইম নম্বর বলে।
সংখ্যারেখায় যে অগণিত স্বাভাবিক সংখ্যা রয়েছে, এরা সবাই হয় কোনো না কোনো মৌলিক সংখ্যা, অথবা এক বা একাধিক মৌলিক সংখ্যার গুণফল। কত সহজে শুধু মৌলিক সংখ্যা দিয়ে পুরো স্বাভাবিক সংখ্যার জগৎকে ব্যাখ্যা করা হয়ে গেল।
এই যে নীতি, এটাকে Fundamental theorem of arithmetic বা পার্টিগণিতের মূল সূত্র বলা হয়। এই সূত্র অনুসারে, 1 ছাড়া যেকোনো স্বাভাবিক সংখ্যাকে এক বা একাধিক মৌলিক সংখ্যার গুণফল রূপে শুধু একটি ভাবেই প্রকাশ করা যায়।
যেমন, 12=2×2×3—এই যে দুই বার দুই আর একবার তিন, এর গুণফল যে 12, এটা আর অন্য কোনোভাবেই পাওয়া সম্ভব নয়।
সংখ্যাতত্ত্বকে বলা হয় গণিতের প্রাণ। আর সংখ্যাতত্ত্বের প্রাণ মৌলিক সংখ্যাগুলো। ইংরেজিতে এদের ডাকা হয় প্রাইম নম্বর (Prime Numbers)। ‘মৌলিক’ শব্দটির প্রকৃতি হলো মূল।
এখন ভেবে দেখার বিষয়, সংখ্যা যত বড় হবে, তার উৎপাদক থাকার সম্ভাবনাও তত বাড়ার কথা। অর্থাৎ মৌলিক সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাওয়ার কথা। তাই নয় কী? তাই–ই হয়। 10,100,1000,10000,100000,1000000–এ প্রাইম আছে যথাক্রমে 4,25,168,1229,9592,78498।
এবার শতকরায় হিসাব করে দেখি, 40%,25%,16.8%,12.29%,9.59%,7.85%। তাহলে কি কমতে কমতে প্রাইম সংখ্যা শেষ হয়ে যাবে? একটু যুক্তি দিয়ে ভাবলেই বুঝা যায়, সেটা হলে সমস্যা হয়ে যেত। অসীম পর্যন্ত এত এত সংখ্যা, এরা তৈরি হতো কীভাবে?
ঠিক তা–ই, অনেক অনেক আগে ইউক্লিড প্রমাণ করে গেছেন যে প্রাইম সংখ্যা অসীম সংখ্যক। এর জন্য ইউক্লিড বৈপরীত্য ব্যবহার করেছিলেন। ধরে নেওয়া যাক, একটা খুব বড় প্রাইম সংখ্যা আছে। এর চেয়ে বড় কোনো প্রাইম সংখ্যা নেই। এখন 2 থেকে শুরু করে সব প্রাইম যদি পরপর গুণ করি, তাহলে আরও অনেক বিশাল একটা সংখ্যা হবে।
এই সুবিশাল সংখ্যাটি আপাতদৃষ্টিতে সংখ্যারেখার সব প্রাইম দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য। এবার এর সঙ্গে 1 যোগ করি। এখন? এই নতুন সংখ্যা কিন্তু আমাদের জানামতে কোনো মৌলিক সংখ্যা দিয়ে বিভাজ্য না। অর্থাৎ সংখ্যাটি হয় নিজে একটি মৌলিক সংখ্যা অথবা আমাদের জানামতে যে বৃহত্তম মৌলিক সংখ্যা, তার চেয়েও বড় একাধিক মৌলিক সংখ্যা দিয়ে গঠিত।
Ads by
অনেক অনেক আগে ইউক্লিড প্রমাণ করে গেছেন যে প্রাইম সংখ্যা অসীম সংখ্যক। বৃত্তের পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ করলে পাই পাওয়া যায়। পাই কিন্তু খুব সুন্দর সংখ্যা!
সংখ্যাতত্ত্বের দুনিয়ায় মৌলিক সংখ্যার গুরুত্ব অনেক। খুবই সুন্দর সে দুনিয়া এবং বড্ড জটিল। তবে আমরা একটু বাইরে থেকে এই মৌলিক সংখ্যাগুলোর কিছু মজার জিনিস দেখে নিতে পারি।
প্রাইম বের করা একটু কঠিন। অনেক অনেক গুণ–ভাগ করতে হয়। তবে একটা জাদুমন্ত্র আছে। 31–এর বামে 3 বসাতে থাকলে প্রাইম তৈরি হতে থাকে। বিশ্বাস না হলে খতিয়ে দেখুন। 331,3331,33331,333331,3333331,33333331—সবগুলো প্রাইম। তবে, জাদুমন্ত্র শেষ হয় 333333331–এ গিয়ে। এটি 17 দ্বারা বিভাজ্য।
আরেকটা জাদুমন্ত্র আছে, তবে এবার উল্টো দিক দিয়ে। 73,939,133 এমন একটি প্রাইম, যার ডান দিক থেকে একটি করে অঙ্ক সরাতে থাকলেও তা প্রাইম থাকে। সত্যি! 7393913,739391,73939,7393,739,73,7সবাই প্রাইম এবং এই রকম বৈশিষ্ট্যসহ প্রাইম এটাই বৃহত্তম।
বৃত্তের পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ করলে পাই পাওয়া যায়। পাই কিন্তু খুব সুন্দর সংখ্যা! সে গল্প আরেকদিন হবে। তবে, পাই–এর এই অঙ্কগুলো নিলে প্রাইম হয় কি না, সেইটা নিয়েও বিস্তর গবেষণা হয়। পাই–এর যে দশমিক বিস্তৃতি, এতে যদি কোনো প্রাইম পাওয়া যায়, তাকে Pi-Prime বলে। যেমন, 3,31,314159,31415926535897932384626433832795028841—এরা সবাই প্রাইম। এমন বিস্তৃতি থেকে সবচেয়ে বড় যে প্রাইম পাওয়া গেছে, তার মধ্যে অঙ্ক আছে 613,373! আপনিও চেষ্টা করে দেখতে পারেন এমন কোনো একটি প্রোগ্রাম লেখার যে পাই, এর বিস্তৃতি থেকে প্রাইম খুঁজে!
শুরুতে প্রাইম নম্বরের নিঃসীমতা প্রমাণ করতে একটি বিশাল প্রাইম ধরে নিয়েছিলাম। এবার আসি আমাদের জানামতে সবচেয়ে বড় প্রাইম সংখ্যাতে। প্রাইম নম্বর এখন আমাদের হাতেকলমে বের করার আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছে। বিশাল বিশাল কম্পিউটার দরকার পড়ে প্রাইম সংখ্যা নিয়ে হিসাব করতে। ম্যারিন মারজেন ১৭ শতকে এমন প্রাইম নিয়ে গবেষণা করেন, যেটা 2–এর কোনো ঘাত থেকে 1 কম। অর্থাৎ, 2p- 1প্রকৃতির। এগুলোকে মারজেন প্রাইম বলা হয়।
এখন যদি p প্রাইম না হয়, তাহলে এই সংখ্যাও প্রাইম হবে না। কম্পিউটার যেহেতু বাইনারিতে কাজ করে, অর্থাৎ আর 1 ছাড়া কিছু বোঝে না, তার জন্য 2–এর ঘাত নিয়ে কাজ করা খুবই সোজা। বাইনারিতে মারজেন প্রাইমগুলো হয় 111111…প্রকৃতির এবং এ কারণেই এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় প্রাইমগুলোর প্রায় সবই মারজেন প্রাইম। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে 277,232,917 এটি গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর আবিষ্কৃত হয়।
শুরুতে প্রাইম নম্বরের নিঃসীমতা প্রমাণ করতে একটি বিশাল প্রাইম ধরে নিয়েছিলাম। এবার আসি আমাদের জানামতে সবচেয়ে বড় প্রাইম সংখ্যাতে।
প্রাইম নিয়ে মজার কথা তো অনেক হলো। এইবার প্রাইম নিয়ে একটু কাজের কথা বলি। এই যে আমরা অনলাইনে মেইল পাঠাই মেসেজ পাঠাই, এই মেসেজগুলো যদি মাঝপথে অন্য কেউ দেখে ফেলে? বা ক্রেডিট কার্ডের পিন ব্যবহার করি, সেটাও যদি কেউ চুরি করে ফেলে? তাহলে তো সমস্যা। তাই এসব বিষয় সাংকেতিক সংখ্যা দিয়ে অনুবাদ করে ফেলা হয়। অর্থাৎ Encode করা হয়। এবং এর জন্য প্রাইম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব পালন করে।
মনে করুন, দুটি মোটামুটি বড় প্রাইম সংখ্যা (১০০-১৫০ ডিজিট) p ও q এবং n = p × q আর k = (p-1) × (q-1)। এবার এমন একটি সংখ্যা e বের করতে হবে, যেন d × e কে k দিয়ে ভাগ করলে 1 অবশিষ্ট থাকে। যখন কেউ কাউকে কোনো বার্তা পাঠায়, সেইটা এমনভাবে পাঠানো হয়, যেন k না জানলে পড়া না যায়। অর্থাৎ, k কে এই তালার চাবি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু, সেটার জন্য তো n কে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করতে হবে! এখানেই সমস্যা। p এবং q যত বড় হয়, n-কে ভেঙে ফেলা ততই কঠিন। এ কারণে প্রায় সব Encoding System–এ বিশাল বিশাল প্রাইমের ব্যবহার করা হয়।
আরেকটি মজার প্রাইম নিয়ে বলে শেষ করি।13532385396179 = 13× 532×3853×96179 একটু খেয়াল করে দেখলেই বিশেষত্বটা বোঝা যাবে! সূত্র: প্রথম আলো।
আপনার মতামত জানানঃ