জলদস্যুর গল্প এখন অনেকটা রূপকথার মতো! অথচ, দেড়শো বছর আগেও বিশ্বজুড়ে রাজত্ব ছিল জলদস্যুদের। বাণিজ্যতরী তো বটেই, অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সিস ড্রেক, ক্যাপ্টেন কিড, ব্ল্যাকবার্ডের মতো জলদস্যুদের ভয়ে কাঁপত ব্রিটেন কিংবা ফ্রান্সের মতো শক্তির রণতরীও।
সম্প্রতি ‘জলদস্যু’ ইস্যুটা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ‘পাইরেট কেন্দ্রিক’ সিনেমা কিংবা উপন্যাস থেকে বেরিয়ে বাস্তবে বেশ নড়েচড়ে বসেছে। কারণ গত ১২ মার্চ এমভি আবদুল্লাহ নামক একটি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয় সোমালি জলদস্যুরা।
পৃথিবীর অন্যতম দস্যুরাষ্ট্র সোমালিয়া। লোহিত সাগর ও আরব সাগরের নীল জলরাশির সমুদ্রতট ঘেঁষে অবস্থিত দেশটির অসংখ্য মানুষ জাহাজ লুটপাট, নাবিকদের অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় কিংবা অতর্কিত হামলা, গোলাবর্ষণ ইত্যাদি সব দুর্ধর্ষ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। ‘সোমালি জলদস্যু’ নামে পৃথিবীজুড়ে কুখ্যাতিরও জুড়ি নেই তাদের।
১৯৬০ সালে ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে সোমালিয়ার জন্ম। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের উৎখাতের পরে যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে দেশটি। পরের দুই দশকের বেশি সময় দেশটিতে কার্যকর কোনো সরকার কিংবা শাসন ব্যবস্থাই ছিল না। জলসীমায় নিরাপত্তা বাহিনীই থাকা তো তখন বিলাসিতা। তখনই মূলত সোমালিয়ার স্থানীয় জেলেরা দস্যুবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। তবে এমনি এমনিই নয়; ভদ্রতার মুখোশধারী কিছু দেশের অনৈতিক কর্মকাণ্ডই এর জন্য দায়ী।
জলসীমার নিরাপত্তা না থাকায় দেশটির সমুদ্রসীমায় ইউরোপীয়দের বেআইনি কর্মতৎপরতা বাড়তে থাকে। রাতের আঁধারে জাহাজে কেমিক্যাল মিশ্রিত শিল্পবর্জ্য খালাস করতে থাকে তারা। এমনকি ফিরে যাওয়ার পূর্বে তারাই ধরে নিয়ে যাচ্ছিল মিলিয়ন ডলার মূল্যের ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ।
বিদেশি মাছ ধরা নৌযানের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। এতে স্থানীয় জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও তেমন কোনো সুফল পাওয়া গেল না। পদক্ষেপের ছিটেফোঁটাও গ্রহণ করেনি কেউ। এতে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় সমগ্র জেলেপাড়ায়। ফলে, তারা দস্যুবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এমনকি তারা বিদেশি জাহাজের ওপর নজরদারি চালানো শুরু করেন।
১৯৯৫ সাল। একদিন আচমকা অদূরে ভেসে থাকা একটি জাহাজের দেখা মিলল। দেরি না করে তারাও ঝটপট তৈরি হয়ে রওনা করল এর জেটির পানে। ছোট নৌকা করে তারা ঘিরে ফেলতে সমর্থ হলো একে এবং ডাঙার কাছাকাছি নিয়ে এলো। জেলেদের কোটরাগত বিবর্ণ চোখ আর শুকনো চোয়ালের মুখাবয়ব দেখে জাহাজের নাবিকরা বেশ ভরকে গেলো।
তাই, তাদের শর্তমতো ক্ষতিপূরণ প্রদানে সম্মত হলো তারা। প্রদান করা হলো মূল্যবান অর্থসামগ্রী। সবকিছু বুঝে নেয়ার পর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক জেলেরাও ছেড়ে দিল তাদের। তখন দেখা গেল, মৎস্য শিকারের চেয়ে দস্যুতায় আয়ের পরিমাণও অনেকগুণ বেশি।
সেদিনের সেই ছোট্ট ঘটনাই মোড় নিল আজকের আধুনিক জলদস্যুতায়। তাড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে জব্দ করে ক্ষতিপূরণ কিংবা মুক্তিপণ আদায় করা যে বেশ সহজ, সেটি বেশ পছন্দ হয় জেলেদের কাছে। হাতে তুলে নেয় আধুনিক অস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজসরঞ্জাম। স্টিলের পাতের ছোট নৌকাগুলোর সাথে এঁটে দেয় শক্তিশালী ইঞ্জিন, পাল্টে দেয় ক্ষিপ্র গতির আক্রমণাত্মক যুদ্ধযানে।
২০০০-১২ সাল পর্যন্ত ছিল সোমালিয়ান জলদস্যুতার স্বর্ণযুগ। সাগরজলে বীরদর্পে চলা এসব জলদস্যু পরিচালনা করেছে শত শত হামলা। শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী না থাকায় এ জলদস্যুরা দেশটির অনেক প্রতিষ্ঠানের ওপরই ছড়ি ঘোরাতে পারে। মুক্তিপণের টাকা বিনিয়োগ করে নিজেদের অপরাধের পরিসরও বাড়ায় তারা। বেকার সোমালি তরুণদের বড় অঙ্কের অর্থের লোভ দেখিয়ে নিজেদের দলে ভেড়ায় এ জলদস্যুরা।
কয়েক বছর তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ওই রুটে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়। এর ফলে ২০১২ সাল নাগাদ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে দস্যুবৃত্তি। তবে, গত কয়েক মাসে সোমালি জলদস্যুদের তৎপরতা বেড়েছে। গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে সোমালি উপকূলে অন্তত ১৪টি জাহাজ হাইজ্যাক করা হয়েছে। সর্বশেষ শিকার বাংলাদেশে পতাকাবাহী জাহাজ!
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আর সময়ের নীরব স্রোতে সোমালিরা আজ পুরো পৃথিবীর নিকট বীভৎস জাতিসত্তা। এ জাতিসত্তার উত্থানে ফুলে ফেঁপে ওঠা উন্নত বিশ্ব কি আদৌ কখনো দায় স্বীকার করবে?
আপনার মতামত জানানঃ