ইউক্রেনের হাতে যে গোলাবারুদ আছে, তা দিয়ে তারা আর বড়জোর এক মাস যুদ্ধ চালাতে পারবে। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেস তাদের আরও অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে এখনো রাজি হতে পারেনি। অন্যদিকে রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি জেলখানায় মারা গেছেন। গাজায় গণহারে মানুষ হত্যা বন্ধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
ইয়েমেনের হুতিরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা জাহাজগুলোতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। উত্তর কোরিয়া আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে।
এ বিষয়গুলো হতাশাবাদকে বাস্তবসম্মত করে তুলছে। ১৯৪৫ সালের পর আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী লেখা, জাতিসংঘের অনুসমর্থন দেওয়া যে বিশ্বব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল, তা আজ সুতায় ঝুলছে।
যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নিজের নীতির ব্যাপারে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ইউরোপ এখন এই আশঙ্কায় ভুগছে যে আসন্ন নভেম্বর নাগাদ আমেরিকা ন্যাটো চুক্তির ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ মেনে তার সম্মিলিত-প্রতিরক্ষা বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণ করতে পারবে না।
এই নতুন অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়ে ইউরোপ তার প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের উৎপাদন বাড়াচ্ছে। ইউরোপীয় রাজনীতিবিদেরা তাঁদের ভোটারদের বোঝাচ্ছেন, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তঁাদের প্রতিরক্ষা খরচ জিডিপির ২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে হবে।
পশ্চিমা জোট শুধু যে আটলান্টিক অঞ্চলজুড়ে ঐক্য বজায় রেখে প্রতিরক্ষা খরচ দ্বিগুণ করার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তা নয়। এই জোট এখন এমন একটি ‘প্রতিরোধ চক্রের’ মুখোমুখি হয়েছে, যা একযোগে একটি সমন্বিত চ্যালেঞ্জ হয়ে পশ্চিমা আধিপত্যকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে।
এই প্রতিরোধ চক্রের মূল চালিকা শক্তি হলো রাশিয়া-চীনের ‘সীমাহীন’ অংশীদারি। এই অংশীদারির অংশ হিসেবে চীনারা রাশিয়ানদের তাদের অস্ত্র ব্যবস্থার জন্য উন্নত সার্কিট সরবরাহ করছে। বিনিময়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চীনে সস্তায় তেল পাঠাচ্ছেন।
এই দুই শক্তি এক হয়ে ইউরেশিয়ার বেশির ভাগ অংশে স্বৈরাচারী শাসন চাপিয়ে দিচ্ছে।
এই দুই দেশ মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে শুধু টিকে থাকেনি বরং তারা লাতিন আমেরিকা, এশিয়া এবং ভারতে নতুন বাজার সৃষ্টি করে উন্নতি অব্যাহত রেখেছে। রাশিয়া এবং চীন উভয়ই আবিষ্কার করেছে যে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ আগের মতো নেই।
যদি ইউক্রেনের ক্লান্ত সেনাদের ক্রিমিয়া ও দনবাস অঞ্চলের ওপর রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়, তাহলে ইউরেশীয় স্বৈরাচারদের অক্ষ শক্তি ইউরোপীয় স্থলসীমানা পরিবর্তন করে ফেলতে সফল হবে।
এই অবস্থা তৈরি হলে তা ইউরেশিয়ার প্রান্তের প্রতিটি রাষ্ট্র (তাইওয়ান, বাল্টিক দেশগুলো এবং এমনকি পোল্যান্ড) হুমকিতে পড়ে যাবে। চীন ও রাশিয়া—উভয় স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তাদের ভেটো ব্যবহার করে অন্য স্বৈরাচারীদের বিজয় অনুমোদন করবে এবং কার্যকরভাবে জাতিসংঘ সনদকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলবে।
এই দুই স্বৈরশাসকের অংশীদারি ইরান এবং উত্তর কোরিয়ার নেতৃত্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অন্যান্য গোষ্ঠীর গুচ্ছ-শক্তির সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে। উত্তর কোরিয়ানরা পুতিনকে কামানের গোলা সরবরাহ করছে এবং ইত্যবসরে তারা তাদের উপদ্বীপের বাকি অংশে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে।
ইরানিরা এমন ড্রোন তৈরি করছে যা পরিখায় অবস্থানরত ইউক্রেনীয়দের মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে ইরানের প্রক্সিশক্তি হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতিরা আমেরিকা ও ইসরায়েলের স্বার্থে আঘাত হেনে রাশিয়া ও চীনকে সাহায্য করছে।
যদি যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতিতে আসতে বাধ্য করতে না পারে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে তিনটি ফ্রন্টে (এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য) সংঘাত নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। কর্তৃত্ববাদী হুমকির বিরুদ্ধে বিশ্বের অন্যান্য গণতন্ত্র আমেরিকা এবং ইউরোপের সঙ্গে এক হয়ে লড়াই করবে—এই ধারণাকে এখন একটি বিভ্রম বলে মনে হচ্ছে।
বৈশ্বিক উত্তরের আক্রান্ত গণতন্ত্রের সঙ্গে যোগ দেওয়ার বদলে বৈশ্বিক দক্ষিণের গণতন্ত্র (ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা) দমন পীড়নকারী চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে অস্বস্তি বোধ করছে না।
নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কর্তৃত্ববাদী চক্রটি বর্তমানে কেবলমাত্র একটি শক্তির বিরোধিতায় এক হয়েছে। সেটি হলো, আমেরিকান শক্তি। এই ইস্যুর বাইরে তারা নিজ নিজ স্বার্থের প্রশ্নে গভীরভাবে বিভক্ত।
উদাহরণস্বরূপ, হুতিরা লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে মালবাহী জাহাজ চলাচলে বাধা দিচ্ছে—এতে চীনারা আনন্দিত হতে পারে না। বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী অর্থনীতির চীনের সঙ্গে দরিদ্র মুসলিম ধর্মতান্ত্রিক ইরানের আদর্শিক মিল নেই।
তদুপরি, মার্কিন জোট দ্বারা টিকে থাকা বৈশ্বিক অর্থনীতির পরজীবী সুবিধাভোগী হলো রাশিয়া এবং চীন। এ কারণেই তারা এখনো মার্কিন আধিপত্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করতে দ্বিধাবোধ করে। তবে হাঙরের মতো তারা পানিতে রক্তের গন্ধ পায়।
এই দুই দেশ মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে শুধু টিকে থাকেনি বরং তারা লাতিন আমেরিকা, এশিয়া এবং ভারতে নতুন বাজার সৃষ্টি করে উন্নতি অব্যাহত রেখেছে। রাশিয়া এবং চীন উভয়ই আবিষ্কার করেছে যে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ আগের মতো নেই।
এ কারণে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে এবং সত্যিকার অর্থেই মার্কিন আধিপত্যকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ