ইংল্যান্ডের সাউথ হ্যাম্পশায়ারের পিটার ও কিম ডার্বিশায়ারের আদরের সন্তান লিয়াম ডার্বিশায়ার। জন্মের সময় মা-বাবার মুখে অনাবিল খুশির বার্তা নিয়ে আসার সাথে সাথে লিয়াম খুব বিরল ধরনের এক রোগকেও নিয়ে আসে নিজের ভিতরে। রোগটি এতই বিরল যে, এখন পর্যন্ত মাত্র হাজার দেড়েক এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঘুমের মধ্যে লিয়ামের শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেত। কারণ তার ফুসফুস সে সময় ঠিকমতো কাজ করতে পারতো না। চিকিৎসকেরা ধরতে পারলেন লিয়ামের রোগটিকে। লিয়াম ওন্ডিন্স কার্সে আক্রান্ত ছিল। তারা ছোট্ট লিয়ামের আনুমানিক জীবনসীমা মাত্র ছয় সপ্তাহ বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার লীলা বোঝার সাধ্যি কার! লিয়াম ডার্বিশায়ার চিকিৎসকদের পূর্বানুমান ভুল প্রমাণ করে আজও বেঁচে আছে।
এখন তার বয়স আঠারো। কিন্তু লিয়ামের এই দীর্ঘ পথচলা একাকী ছিল না; ছিল না সহজসাধ্য। বলা যায়, এক অসম্ভবকে সম্ভব করে বেঁচে আছে এই পৃথিবীর লিয়াম ডার্বিশায়ার। লিয়ামকে ঘুমের সময় কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র নিয়ে ঘুমাতে যেতে হয়। ঘুমন্ত লিয়ামের উপর সর্বদা নজর থাকে কারো না কারো। কারণ তার বেখেয়ালের ঘুম যেকোনো দুর্ঘটনায় চির ঘুমে পরিণত হতে পারে।
এই রোগটি মূলত কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের যে অংশটি স্বয়ংক্রিয় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে সৃষ্ট ঝামেলার কারণে উদ্ভূত। ঠিক কোন কারণে এই রোগটা হয় তা সম্পূর্ণরূপে বের করা যায়নি এখনো। তবে পিএইচওএক্স২বি (PHOX2B) নামক একটি জিনের এক্ষেত্রে জড়িত থাকার বিষয়ে কিছুটা প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই জিনটি মানব ভ্রূণের ক্রমবিকাশের একদম প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু স্নায়ুকোষ (নিউরন) তৈরিতে ভূমিকা পালন করে।
আরো নির্দিষ্ট করে বললে, মানব কোষের চার নাম্বার ক্রোমোসোমে অবস্থিত এই জিনটি আমাদের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের (Autonomic nervous system) বিকাশের সাথে বিশেষভাবে জড়িত। এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় আমাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু জৈবনিক প্রক্রিয়া- হৃদপিণ্ডের ছান্দিক শব্দ কিংবা নিঃশ্বাসের ফোঁসফোঁস, আমাদের হজম ক্রিয়া বা চোখের নাচন, যৌন উত্তেজনা অথবা রেচন। PHOX2B জিনে মিউটেশন হলে প্রায় ৯১% কেসেই Congenital central hypoventilation syndrome হয়ে থাকে দেখা গেছে।
অনেকের মনে হয়তো ইতোমধ্যেই একটা প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। আচ্ছা, এই রোগে মা-বাবার দায় কতটুকু? নির্দিষ্ট কেউ কি ‘দায়ী’ এজন্য? উত্তর হলো- না, নির্দিষ্টভাবে কেউ ‘দায়ী’ নয়। এই রোগের বংশগতিক ধারা Autosomal dominant pattern মেনে পরবর্তী প্রজন্মের ভিতর আসে। তবে এটা তেমন একটা দেখা যায় না। তারপরও Autosomal dominant ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করে বলি। আমাদের দেহে যে ডিএনএ (DNA) আছে এইটা তো আমরা কমবেশি সবাই জানি। এটি বংশগতির ধারক ও বাহক। অন্যদিকে জিন হল বংশগতির বাস্তব এবং কার্যকরী একক।
আর মানবদেহে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম রয়েছে, যার ২২ জোড়াই অটোসোম এবং ১ জোড়া সেক্স ক্রোমোজোম যার মাধ্যমে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। কোষে মূলত প্রতিটি জিনের দুটি করে কপি থাকে যার একটি আসে বাবা থেকে, আরেকটির উৎস মা। এখন কোনো এক জোড়া অটোসোমে অবস্থিত একটি নির্দিষ্ট জিনের যেকোনো একটি কপিতে মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটলে যদি সেটা পরবর্তী প্রজন্মে প্রকট হিসেবে প্রকাশিত হয় তবে তাকে Autosomal dominant pattern বলে। তবে এই রোগের জন্য শতকরা ৯০ ভাগের উপরে দায়ী ভ্রূণের পরিস্ফুটন ও বৃদ্ধিকালীন সময়ে হওয়া মিউটেশন, যা ভ্রূণ মা বা বাবা কারো থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পায় না। অর্থাৎ একটি নতুন মিউটেশন।
আবার ৫ থেকে ১০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, তারা জিনটি তাদের পিতামাতা কারো কাছ থেকে মিউটেশন অবস্থাতেই পেয়েছে; অথচ যার কাছ থেকে পেয়েছে সেই মা বা বাবা এই রোগে আক্রান্ত থাকে না।
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ঘুমের মধ্যে অ্যাপনিয়া (Apnea) দেখা দেয়। অ্যাপনিয়া হলে বহিঃশ্বসন প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ততা আসে। শ্বসনতন্ত্রের পেশিকলার নড়াচড়া থেমে যায়। ফলে ফুসফুস তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আর চালু রাখতে পারে না। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়; পাশাপাশি বৃদ্ধি পেতে থাকে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ। ফলে ত্বক বা ঠোঁট নীলাভ হয়ে যেতে পারে যাকে Cyanosis বলে।
হতে পারে ডিসফ্যাগিয়া (Dysphagia); ফলে খাবার গিলতে কষ্ট হয় রোগীর। দেখা দিতে পারে হির্শপ্রুংস রোগ (Hirschsprung’s disease)। এই রোগে পরিপাকতন্ত্রের বিশেষত বৃহদান্ত্রের বিশাল অংশ জুড়ে কোনো স্নায়বিক সংযোগ থাকে না। এর ফলে শরীরে তৈরি হওয়া মানববর্জ্য বের হবার জন্য যে দু’টি প্লেক্সাস (Plexus) এর প্রয়োজন তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। পরিপাকতন্ত্রের স্নায়ুতন্ত্রে এই দুই রকমের প্লেক্সাসের একটি হল আউরবাখ্স প্লেক্সাস (Auerbach’s plexus); আরেকটি মেইসনার্স প্লেক্সাস (Meissner’s plexus) । কিছু ক্ষেত্রে সিমপ্যাথেটিক গ্যাংলিয়াতে টিউমার তৈরি হতে পারে যাকে নিউরোব্লাস্টোমা বলে। এছাড়া মাথাব্যথা, ঝিমুনি ও উচ্চ রক্তচাপ- মাঝে মাঝে এগুলোও যোগ দেয় ভোগান্তির তালিকায়।
কিভাবে আজও বেঁচে আছে বিস্ময়মানব লিয়াম ডার্বিশায়ার! এই রোগের রোগীদের বেঁচে থাকার জন্য আজীবন যান্ত্রিক ভেন্টিলেশন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে থাকতে হয়। তবে এটার একটা সমস্যাও আছে। এই পদ্ধতিতে অনেক ক্ষেত্রে ট্রাকিয়োটমি (Tracheotomy) করতে হয়। এটি এক ধরনের সার্জিক্যাল প্রক্রিয়া। তবে অধুনা বাইফেসিক কুইরাস ভেন্টিলেশন (Biphasic Cuirass Ventilation) নামে আরেকটি পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে যেখানে এই ট্রাকিয়োটমি করতে হয় না। এছাড়াও ফ্রেনিক নার্ভ পেসিং (Phrenic Nerve Pacing) নামে আরেকটি পদ্ধতি আছে। 8 তবে এই সমস্ত প্রক্রিয়াই অনেক ব্যয়বহুল যা বহু সাধারণ্যের নাগালের বাইরে থেকে যায়। অনেক গবেষক কি মনে করেন জানেন? অনেক শিশুই হয়তো এই ওন্ডিস কার্সের কারণেই মারা যায় যাদের আমরা হঠাৎ শিশুমৃত্যু (sudden infant death syndrome বা SIDS) হিসেবে অন্য খাতে ফেলে দিই।
সমাপ্তি কোনো হতাশা বা মৃত্যুর কথা বলে করতে চাই না। আর তাই এত কষ্টের পরেও জীবন স্রোতের বিপরীতে বেঁচে থাকা যোদ্ধা লিয়াম ডার্বিশায়ারের হাসিখুশি সুখী মুখটা দেখে ইতি টানি। মানুষ তো আশার ভেলায় ভেসেই বেঁচে থাকে, তাই না? আর সে কারণেই লিয়াম স্কুলে যায়, ফুটবল খেলে তার ভাইবোনদের সাথে। লেগো দিয়ে বিভিন্ন জিনিসের রেপ্লিকা মডেল তৈরি করা তার প্রিয় একটি কাজ।
আপনার মতামত জানানঃ