দুই-তিন বছর আগেও বলা হতো, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো বেশ সুসংহত। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন বা পাঁচ হাজার কোটি ডলার ছুঁই ছুঁই করত। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি খাত জমে উঠেছিল। মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় টাকাকে শক্তিশালী অবস্থায় রাখা হয়েছিল।
আবার রাজস্ব ছিল আদায় গতানুগতিক। সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো ঠিকঠাকই ছিল। এ রকম অবস্থায় কোভিডের প্রভাব শুরু হলে এবং এরপর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ দেখা দিলে এক এক করে সূচকগুলোর অবনতি হতে থাকে। এখন প্রায় সব সূচকই ঝুঁকিতে পড়ে গেছে।
নতুন সরকার এসে সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব সূচকে নজর দিতে হবে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়, ব্যাংক খাত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশি ঋণ, রাজস্ব আয় ইত্যাদি।
এসব নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘উত্তরাধিকারসূত্রে বড় সংকট নিয়ে আমরা ২০২৪ সাল শুরু করতে যাচ্ছি। তাই সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই নতুন বছরের লক্ষ্য হওয়া উচিত।’
জাহিদ হোসেনের মতে, মোটাদাগে অর্থনীতিতে এখন তিনটি সমস্যা আছে। এগুলো হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা ও আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা।
দোলাচলে রপ্তানি খাত
রপ্তানিতে নভেম্বর ও অক্টোবর মাসে নেতিবাচক আর বাকি চার মাসে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এক দশক ধরে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে রপ্তানি খাত ছিল অন্যতম ভালো খাত। এটিও এখন দোলাচলে আছে। এই খাতের এমন অবস্থা নিয়েই বছর শুরু হলো। রপ্তানি বাড়লে দেশে ডলার আসে, যা বৈদেশিক রিজার্ভকে আরও সুসংহত করে।
ছয় মাস ধরে রপ্তানি খাতে কখনো ইতিবাচক, কখনোবা নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে। এমন দোলাচলে সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে অবশ্য রপ্তানিতে ৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই সময়ে ৫৩৬ কোটি ডলার রপ্তানি হয়েছে।
রিজার্ভের দুর্দশা
২০২৩ সালের শুরুটা হয়েছিল প্রায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে। এই হিসাব অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গতানুগতিক হিসাবপদ্ধতি। তখন রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি ছিল না। গত এক বছরে রিজার্ভ শুধু কমেছে। সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসের শেষে আইএমএফের বিপিএম-৬ হিসাবপদ্ধতি অনুসারে, রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৪৪ কোটি ডলার।
অস্থির ব্যাংক খাত
ডলারের বিনিময় হার তথা দাম নিয়ে পুরো ব্যাংক খাত যেন অস্থির হয়ে আছে। ডলার–সংকট নিয়ে নতুন বছর শুরু হলো। ২০২৩ সালের শুরুতে ডলারের দাম ছিল ১০৩ টাকা। বছরের শেষে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১১০ টাকা। যদিও আমদানি পর্যায়ে ব্যাংকগুলোতে ডলারের দাম ১২২-১২৩ টাকা উঠছে। এর ফলে আমদানিকারকদের বাড়তি দামে ডলার কিনে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে।
ব্যাংক খাতের ‘চিরন্তন’ সমস্যা খেলাপি ঋণ। গত বছরজুড়ে খেলাপি ঋণ ছিল লাগামছাড়া। সেই লাগামহীন খেলাপি ঋণ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বছর। দেশের ব্যাংক খাতে ২০২২ সালের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা বিদায়ী ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া বেশ কিছু ব্যাংক তারল্যসংকটে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। ব্যাংক খাতের দুর্দশার প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে পড়ছে।
বড় চিন্তা উচ্চ মূল্যস্ফীতি
নতুন বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ে বড় চিন্তায় থাকতে হবে নীতিনির্ধারকদের। কারণ, মূল্যস্ফীতি কিছুতেই ৯ শতাংশের নিচে নামছে না। বাজারেও ভোগ্যপণ্যের দাম খুব একটা কমেনি। গত মার্চ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। আর চার মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি।
ডিসেম্বর মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। মূল্যস্ফীতি গণনা শেষ হলেও পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে বিবিএস। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ভোটের কারণে কিছুদিন ধরেই নিজের নির্বাচনী এলাকা সুনামগঞ্জে আছেন।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘খাদ্যনিরাপত্তা’–সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাবারের ক্রমবর্ধমান দাম দেশের ৭১ শতাংশ পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশে এখন মোট পরিবার বা খানার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মানলে, খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা ২ কোটি ৯০ লাখের বেশি পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয়।
প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩%
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস হলো বৈধ পথে আসা প্রবাসী আয়। কিন্তু ডলারের দামের পার্থক্যের কারণে বৈধ পথে ডলার আনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন গতি আনতে পারেনি।
গত বছর ডলার-সংকট ছিল প্রকট। যে কারণে ডলারের দাম নিয়ে নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষা, বেশি দামে প্রবাসী আয় কেনা, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়াতে অতিরিক্ত প্রণোদনা প্রদানসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপরও বৈধ পথে প্রবাসী আয় কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়েনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, বিদায়ী ২০২৩ সালে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ১৯০ কোটি ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ২ হাজার ১৩০ কোটি ডলার। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩ শতাংশ। এর আগে ২০২১ সালে ২ হাজার ২০৭ কোটি, ২০২০ সালে ২ হাজার ১৭৩ কোটি ও ২০১৯ সালে ১ হাজার ৮৩৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল।
আপনার মতামত জানানঃ