আনিস রায়হান
দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে ক্ষমতার রাজনীতি এখন যে ধারায় চলছে এবং যারা চালাচ্ছে উভয়েরই গোড়াপত্তন করেছিল ব্রিটিশ দখলদার শক্তি। ‘শিক্ষিত, সুসভ্য, আধুনিক ও অগ্রসর’ ব্রিটিশ শাসকশ্রেণি ভারতে তাদের অব্যাহত লুণ্ঠন ও নিপীড়নের যুগে কোথাও রশি আলগা হতে দেখলে কিংবা দমনযন্ত্র অসাড় হয়ে পড়লে আদালত কিংবা সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করত। মানুষে মানুষে বিরাজমান অবৈরী সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বকে বৈরী রূপ দিত। যে কারণে ব্রিটিশ আমলে বহু আগুন লেগেছে, মানুষ হতাহত হয়েছে এবং এগুলোর নাম হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
পরবর্তীকালে এ অঞ্চলের দেশগুলোতে ব্রিটিশের অনুসারীদেরই ক্ষমতায়ন হয়েছে, ব্রিটিশরাই সেই ব্যবস্থা করে রেখে গেছে। ফলে এখানকার দেশগুলোতে শাসকরা বরাবরই ‘ধর্মীয় পরিচয়’কে পুঁজি করেছে এবং এটাকে ব্যবহার করে নিজেদের দুরবস্থা মোকাবিলার চেষ্টা করেছে। জনসমর্থন আদায়ে, নিজেদের স্বার্থ হাসিলে এটাই তাদের সবচেয়ে পছন্দের পথ। ভারতে সম্প্রতি এই সাম্প্রদায়িকতার সবচেয়ে কুৎসিত চেহারাটি দেখা গেছে। যদিও এর সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের সংযোগকে অনেকেই আমলে নেন, কিন্তু এর পেছনের অর্থনৈতিক কার্যকারণ ততটা আলোচিত হয় না।
দেশভাগের কালে ভারতে ও পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সবচেয়ে তীব্র হয়েছিল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লাখ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। হিসাবপত্র ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ও ১ কোটি ২০ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার কথা বলে। কিন্তু উভয় সংখ্যাই এর দ্বিগুণের কম ছিল না বলেও শক্ত দাবি রয়েছে। অথচ এই ভারতবর্ষেই সুদীর্ঘকাল ধরে অসংখ্য ছোট-বড় জাতিগোষ্ঠীর বাস এবং প্রত্যেকের মধ্যেই হিন্দু-মুসলিম ও আরও অনেক ধর্মের অনুসারী ছিল, এখনও রয়েছে।
১৮৪৮ সালের আগে, ভারতবর্ষে কোথাও কখনও কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। ব্রিটিশ দখলদাররা তাদের ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে ধর্মীয় বিভাজন চাঙ্গা করেছিল এবং দাঙ্গা ছিল তারই পরিণতি। তাদের অনুসারীরাও নিজ নিজ ক্ষমতাকে সুসংবদ্ধ করতে এখন অবধি সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছে।
ধর্মীয় পার্থক্যের কারণে লোকেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অবশ্যই ছিল। কিন্তু তা কখনও ভয়াবহ বৈরী রূপ ধারণ করেছে বলে ইতিহাসে কোনও সাক্ষ্য মেলে না। ঐতিহাসিক সুমিত সরকার দেখিয়েছেন যে, উনিশ শতকের আগে, সুনির্দিষ্ট করে বললে ১৮৪৮ সালের আগে, ভারতবর্ষে কোথাও কখনও কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। ব্রিটিশ দখলদাররা তাদের ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে ধর্মীয় বিভাজন চাঙ্গা করেছিল এবং দাঙ্গা ছিল তারই পরিণতি। তাদের অনুসারীরাও নিজ নিজ ক্ষমতাকে সুসংবদ্ধ করতে এখন অবধি সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছে।
দেশভাগের পর পাকিস্তানে এর সবচেয়ে চরম প্রকাশ দেখা গেছে। মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসকরা এরপর আর দেশের অভ্যন্তরে সেই অর্থে হিন্দুদের পায়নি। কিন্তু মতের পার্থক্য হলেই তারা একে অপরকে ‘হিন্দুদের এজেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাঙালিদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আন্দোলনকেও এভাবেই চিহ্নিত করা হয়েছিল। ফল হিসেবে সেই ধর্মীয় ঐক্যের বাতাবরণ ভেঙে পড়েছে এবং দেশটি দুই ভাগ হয়ে গেছে।
ভারতে ঠিক দেশভাগের পরেই এরকম ঘটনা ঘটেনি বরং এটা ঘটেছে একেবারে আধুনিক সময়ে, গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। ভারতীয় শাসকরা এই দীর্ঘ সময় ধর্ম প্রশ্নে প্রধানত নরমপন্থা অবলম্বন করেছে। তারা খুব উদার ছিল বলে এমনটা ঘটেনি। মূলত ভারত ছিল তখন সোভিয়েত ব্লকে। যে রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ, নিপীড়িত মানুষের জেগে ওঠার মধ্য দিয়ে। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সাম্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা সেই রাষ্ট্র ১৯৫৬ সালের পর আর ওই চরিত্র ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তারা স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েই টিকে ছিল।
দেশভাগের সময় অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের একাংশ নেতৃবৃন্দ ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, তারা চেয়েছিল নিদেনপক্ষে বাংলা ভাগ না হোক। কিন্তু কংগ্রেসের সে সময়কার প্রধান নেতৃত্ব মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সরদার বল্লভভাই প্যাটেলরা সেই প্রচেষ্টা নস্যাৎ করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।
সোভিয়েত রাষ্ট্রের মিত্র হওয়ায় তাদের কিছু প্রভাব ভারতের ওপরও পড়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত হওয়া সত্ত্বেও ভারতের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে সোভিয়েতের সূত্রেই ‘সেকুলারিজম’ বা ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এটা যে সোভিয়েতের প্রভাবেই ঘটেছিল, তা জোর দিয়ে বলা যায়। কারণ দেশভাগের সময় অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের একাংশ নেতৃবৃন্দ ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, তারা চেয়েছিল নিদেনপক্ষে বাংলা ভাগ না হোক। কিন্তু কংগ্রেসের সে সময়কার প্রধান নেতৃত্ব মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সরদার বল্লভভাই প্যাটেলরা সেই প্রচেষ্টা নস্যাৎ করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।
দেশভাগ সুনিশ্চিত হওয়ার পর অবিভক্ত বাংলার পক্ষের সবচেয়ে বড় নেতৃত্ব প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমকে উদ্দেশ করে গান্ধী সহাস্যে বলেছিলেন, ‘হাশিম তুমি পরাজিত হয়েছো… তুমি বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে পারলে না।’ সে সময় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের নেতা শরৎচন্দ্র বসুকেও বঙ্গভঙ্গবিরোধী অবস্থান নেয়ার জন্য পত্রযোগে গান্ধী তিরস্কার করেছিলেন। কলকাতার দাঙ্গায় যেসব স্থানে মুসলিমরা আক্রান্ত হয়েছিল, সেসব স্থানে গান্ধী কখনও হতাহতদের পরিবারের দুর্দশা দেখতে যাননি। কিন্তু নোয়াখালীর দাঙ্গায় হিন্দুরা আক্রান্ত হওয়ায় তিনি ওই এলাকা সফর করেছিলেন। এহেন রাজনৈতিক চর্চার উত্তরাধিকার নতুন ভারত রাষ্ট্রের শাসকরা বহন করছিল বিধায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তাদের হাতে গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না।
ভারতে সাম্প্রদায়িকতার রাশ টেনে ধরাটা যে সোভিয়েতের প্রভাবেই ঘটেছিল তার আরেকটি উদাহরণ হলো, সোভিয়েত বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকেই ভারতে হিন্দুত্ববাদী দলগুলো দ্রুতগতিতে শক্তিশালী হতে থাকল এবং মাত্র তিন দশকের ব্যবধানে সেখানে তারা একটি হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করার কাজ অনেকখানি এগিয়ে নিতে পেরেছে। আমাদের সবার চোখের সামনে দিয়েই এই তো বছর দুয়েক আগেই বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি।
চলতি দফায় ক্ষমতায় এসেই তারা ভারতীয় মুসলিমদের অধিকার সীমিত করা, মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর জনসংখ্যার নতুন বিন্যাস ঘটানো এবং ভারত ত্যাগে মুসলিমদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে। যার অংশ হিসেবে প্রথমত তারা জম্মু-কাশ্মীরকে বিভক্ত করে ফেলেছে এবং রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়ে সেখানে অন্য রাজ্যের লোকদের জমি কেনার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এর আগে দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য আসামে নাগরিকপঞ্জি করে ১৯ লাখ নাগরিকত্বহীন মানুষ ‘আবিষ্কার’ করেছে। এরপর নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে ‘নাগরিকত্ব নেই’ মর্মে চিহ্নিত মুসলিমদের রাষ্ট্রহীন করে ফেলার প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছে।
হিন্দুত্ববাদের এই বিকাশ ভারতের জনগণ মেনে নেয়নি। নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের জেরে প্রায় সারা ভারতেই বিক্ষোভ ঘনীভূত হয়েছে। বিজেপি ও তার সমর্থকরা চেষ্টা করেছে এসব বিক্ষোভকে ‘পাকিস্তানি এজেন্ট’দের কাজ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে। কিন্তু দিল্লির শাহিনবাগের লাগাতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন তাদের ভড়কে দেয়। সেখানে কোনোভাবেই হিংসার বিস্তার ঘটানো সম্ভব হয়নি এবং যত দিন গেছে শাহিনবাগ সবার কাছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
ভারতে সাম্প্রদায়িকতার রাশ টেনে ধরাটা যে সোভিয়েতের প্রভাবেই ঘটেছিল তার আরেকটি উদাহরণ হলো, সোভিয়েত বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকেই ভারতে হিন্দুত্ববাদী দলগুলো দ্রুতগতিতে শক্তিশালী হতে থাকল এবং মাত্র তিন দশকের ব্যবধানে সেখানে তারা একটি হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করার কাজ অনেকখানি এগিয়ে নিতে পেরেছে।
ভারত ও দিল্লির শাসকরা সেটা মেনে নিতে পারেনি। এরপর যখন তারা দেখল শাহিনবাগের মতো করে আরও কয়েকটি এলাকায় মানুষ রাস্তায় নেমে আসছে, তখন এদের প্রতিহত করতে মরিয়া হয়ে গেল তারা। ২০১৯ সালের শীতের শেষে মানুষ দেখেছে দিল্লিজুড়ে হিন্দুত্ববাদীদের পরিকল্পিত তাণ্ডব। করোনভাইরাস সংক্রমণের পর দিল্লিসহ পুরো ভারতজুড়ে হিন্দুত্ববাদীদের আস্ফালন কিছুটা সীমিত হলেও তা থেমে যায়নি। বরং আইন করে হিন্দু-মুসলিম বিয়ে ঠেকানোর মতো সাম্প্রদায়িকতার চর্চা রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে যেসব কৌশল বহু ব্যবহৃত, তার একটি হলো- নিজের লোক মেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানো। কিংবা ছদ্মবেশে প্রতিপক্ষের মিছিলে ঢুকে পড়ে সংঘর্ষ তৈরি করার পথ প্রস্তুত করা। দিল্লির ওই আন্দোলনে এসব চর্চা ব্যাপকভাবেই হয়েছে। ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মুসলিমদের পাকিস্তানপন্থি প্রমাণ করতে তাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে ছদ্মবেশে পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দিয়ে পরিস্থিতি গরম করার চেষ্টাও বাদ যায়নি।
দিল্লিতে সর্বশেষ ওই ব্যাপক সহিংসতায় একজন বিচারপতি পুলিশকে ডেকে তিরস্কার করেন এবং হামলায় প্রকাশ্যে মদদ দেয়ার ছবি দেখিয়ে কয়েকজন বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে কেন মামলা রুজু করা হলো না জানতে চান। কোনও সদুত্তর না পেয়ে তিনি তাদের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ জারি করেন। সেই রাতেই বিজেপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি তার বদলির কাগজে স্বাক্ষর করেন এবং বিচারপতিকে ঝড়ের গতিতে তল্পিতল্পা গুটিয়ে দিল্লি ছাড়তে হয়। এ নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বা প্রধান বিচারপতি কখনও মুখ খোলেনি। তবে সুপ্রিম কোর্ট ও প্রধান বিচারপতি তার কিছুদিন আগে লোককথাকে ভিত্তি ধরে, কোনও প্রমাণ না পাওয়া সত্ত্বেও বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণের আদেশ দিয়েছিল। ফলে এটা মোটামুটি স্পষ্ট যে, বিজেপি পরিবার ভারত রাষ্ট্রকে নতুন ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে।
কথা হলো, হিন্দুত্ববাদিরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছে। তারা আইন সংশোধন করছে, লোকের নামে মামলা দিচ্ছে, পুলিশ দিয়ে হয়রানি করতে পারছে। তবু কেন তাদের লাঠিসোটা নিয়ে নামতে হয়, কেন দুর্বল সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিতে হয়? কেন তাদের আশি বছরের বৃদ্ধাকে হত্যা করতে হয়? কেন তাদের জ্বালাও পোড়াও করে চেতনার উষ্ণতা-উদ্দীপনা তৈরি করতে হয়? তারা কি তাহলে অসাড় হয়ে পড়ছে? তারা কি বুঝতে পারছে যে, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে? তেমন আশঙ্কা না করলে কেন তারা ঝুঁকি নিচ্ছে?
ভারতের শাসকরা বর্তমান পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থায় এখনও ক্রীড়নকের ভূমিকায় রয়েছে। কিন্তু তারা উত্থানের স্বপ্ন দেখে। ভারতীয় পুঁজির দখল ও শাসন প্রতিষ্ঠা তাদের লক্ষ্য। এ অবস্থায় প্রতিবেশীদের নিয়ে ঘৃণা ছড়ানো এবং তাদের ওপর আধিপত্য কায়েমের রাজনীতি তারা সামনে নিয়ে এসেছে। এর সপক্ষে সমর্থন আদায় করতে দেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় বিভাজনকে মুখ্য করে তুলেছে।
ভারতে বর্তমান শাসনকাঠামোকে জার্মানিতে হিটলারের উত্থানযুগের সঙ্গে অনেকেই তুলনা করেন। জার্মান অর্থনীতির সংকটকে পুঁজি করে হিটলার সব সমস্যার জন্য সংখ্যালঘু ইহুদিদের দায়ী করেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে ধ্বংস করে দিয়ে জার্মান আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হন। তখনকার বিশ্বে যে বাজারব্যবস্থা চালু ছিল, সেখানে জার্মানির কোনও হিস্যা ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের জেরে জার্মানিকে এই অবস্থার মুখে পড়তে হয়েছিল। এসব সমস্যা সমাধানে হিটলার যুদ্ধংদেহী নীতি ঘোষণা করেন এবং উগ্র জাতীয়তাবাদও ধর্মকে পুঁজি করে বাজার ব্যবস্থায় অংশীদারিত্ব আদায়ে মাঠে নামেন।
ভারতের শাসকরা বর্তমান পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থায় এখনও ক্রীড়নকের ভূমিকায় রয়েছে। কিন্তু তারা উত্থানের স্বপ্ন দেখে। ভারতীয় পুঁজির দখল ও শাসন প্রতিষ্ঠা তাদের লক্ষ্য। এ অবস্থায় প্রতিবেশীদের নিয়ে ঘৃণা ছড়ানো এবং তাদের ওপর আধিপত্য কায়েমের রাজনীতি তারা সামনে নিয়ে এসেছে। এর সপক্ষে সমর্থন আদায় করতে দেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় বিভাজনকে মুখ্য করে তুলেছে। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে অটোমেশনের প্রভাব।
চলমান কথিত ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’ তথা অটোমেশনের কারণে শ্রমবাজারে বিরাট ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। শিল্পমালিকরা উন্নত যন্ত্রপাতি নিয়োজিত করে শ্রমের ব্যয় কমাতে তৎপর। এজন্য অনেক মানুষ বেকার হচ্ছে, হতে বসেছে। এই প্রক্রিয়ায় শ্রমের দাম আরও কমবে। কর্মহীন শ্রমজীবীদের মধ্যে কাজ পাওয়ার প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং তারা কম মজুরিতে হলেও কাজ করবে। করোনা এই প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।
ভারতের শাসকরা ইউরোপীয় শাসকদের কায়দায় শ্রম অধিকার হরণ করে অটোমেশন বাস্তবায়নের পথে যেতে রাজি থাকলেও রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে তাদের সামনে মোক্ষম অন্য পথও খোলা রয়েছে। তারা বিপুলসংখ্যক সংখ্যালঘুদের অধিকার কেড়ে নিয়ে কর্মসংস্থানের বাজারে চাপ কমাতে চায় এবং এই প্রক্রিয়ায় শ্রমবাজারে মজুদ শ্রমিকের সংখ্যা বাড়াতে চাইছে।
তাছাড়া এই পথ ধরে এগুনোর ফলে দেশের অভ্যন্তরে এতদিন যেসব এলাকা বা ব্যবসাক্ষেত্র বিশেষ জাতি বা গোষ্ঠীর আওতাধীন ছিল, সেসব স্থানে বড় পুঁজিপতিশ্রেণির দখল প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়ে যাচ্ছে। যেমন কাশ্মীরে কিছু বিশেষায়িত ব্যবসা আছে, পর্যটন, পোশাক ও আপেলের। এগুলোর ওপর বড় পুঁজিপতিদের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে ওই এলাকার আইন ও জনবিন্যাসে পরিবর্তন আনা তাদের জন্য জরুরি ছিল। ফলে সাম্প্রদায়িকতা দৃশ্যমান সংকটের একমাত্র কারণ মনে হলেও বাস্তবে এর পেছনে রয়েছে একচেটিয়া পুঁজির বিকাশের চাপ।
আশেপাশের দেশগুলোকে নিজেদের বাজারে পরিণত করার জন্য ভারতের শাসকশ্রেণিকে যে আগ্রাসন চালাতে হবে, তার ভিত্তিও প্রস্তুত করছে এই সাম্প্রদায়িকতা। নিজেদের উন্নত ও সভ্য দাবি করে, অন্যদের পশ্চাৎপদ, বর্বর বলে প্রতিষ্ঠা করা গেলে ওইসব দেশে বা সমাজে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজ সহজ হয়ে যায়। ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্র তাই একযোগে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করে চলেছে।
আশেপাশের দেশগুলোকে নিজেদের বাজারে পরিণত করার জন্য ভারতের শাসকশ্রেণিকে যে আগ্রাসন চালাতে হবে, তার ভিত্তিও প্রস্তুত করছে এই সাম্প্রদায়িকতা। নিজেদের উন্নত ও সভ্য দাবি করে, অন্যদের পশ্চাৎপদ, বর্বর বলে প্রতিষ্ঠা করা গেলে ওইসব দেশে বা সমাজে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজ সহজ হয়ে যায়। ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্র তাই একযোগে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করে চলেছে। এ প্রশ্নে সেখানকার অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই একমত এবং এর প্রকাশ ঘটে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যে কোনও দ্বন্দ্ব তৈরি হলে দ্রুতই সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের পুলওয়ামা জেলায় জঙ্গি হামলার পর ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল মোদি সরকারকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে পাকিস্তানকে কড়া জবাব দেয়ার জন্য। এর মধ্যে কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম, সবাই ছিল। যার অর্থ হলো অব্যাহত সাম্প্রদায়িক উসকানি ও কাশ্মীর ঘিরে ভারতের শাসকশ্রেণির গৃহীত নীতির প্রেক্ষিতেই যে এই পাল্টা সন্ত্রাসের জন্ম, তা আমলে না নিয়ে, সরকারকে নীতি বদলের আহ্বান না জানিয়ে বরং সকলেই ভারতীয় আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার পক্ষে স্লোগান ধরল। ভারতে ও দক্ষিণ এশিয়ায় বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি না করে এই শক্তিগুলো থামবে না।
কিন্তু আমরা তবু আশাবাদী হতে পারি। কারণ সব ঘটনায় আমরা গণমানুষের একটি অংশের ঐক্য দেখেছি। আগ্রাসীদের তুলনায় তাদের সংখ্যা কম হলেও এই অংশটিই মনুষ্যত্বের বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাধর পক্ষগুলোকে যদিও খুব বেশি শক্তিশালী মনে হচ্ছে, কিন্তু এরা ক্ষয়িষ্ণু। ক্ষয়িষ্ণু বলেই তারা মরণ কামড় দিচ্ছে। প্রতিবাদকারীদের দেখে যদিও দুর্বল মনে হচ্ছে, কিন্তু এটাই মানুষের বিকাশের পথ।
জগতের নিয়মেই পুরনো ক্ষয়িষ্ণু শক্তিকে নব জন্মলাভকারী শক্তির জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। সেজন্য সময় লাগবে, কঠিন লড়াই হবে। তবে শেষ অবধি পুরনো শক্তিকেই বিদায় নিতে হবে। ইতিহাসে অন্ধকার সময়ের তালিকা ও দৈর্ঘ্য বিশাল। কিন্তু বারবারই মানুষ জেগে উঠেছে এবং নতুন নিয়ম ও নীতি প্রতিষ্ঠা করেছে। এবারও মানুষ জেগে উঠবে। মানুষের জেগে ওঠার নজির চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও দেখা যাচ্ছে।
raihananis87@gmail.com
আপনার মতামত জানানঃ