যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে হত্যা করার হুমকি দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফরিদুল আলম। আজ বুধবার তাঁর ওই বক্তব্যের একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
আওয়ামী লীগ নেতার এমন বক্তব্যে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।
মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে ৬ নভেম্বর কর্মী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন ফরিদুল আলম। সেই বক্তব্যের ২৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপ আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ভিডিওতে ফরিদুল আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনারা জানেন, বাংলাদেশে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। কী একটা পাতি হাঁস আসছে। পিটার হাস বদমাইশ। সে বিএনপির হয়ে যে অসভ্য কাজকারবারগুলো বাংলাদেশে করছে, তাকে পেলে জবাই করে মানুষকে খাওয়াইতাম। সেই পিটার হাস, বদমাইশ।’
৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় কালারমারছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত ওই সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক সিরাজুল মোস্তফা। প্রধান বক্তা ছিলেন সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক। উপস্থিত ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার পাশা চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক তারেক বিন ওচমান শরীফ প্রমুখ।
বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদুল আলম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এই ধরনের বক্তব্য দিইনি। পিটার হাস আমাদের মেহমান। আমি মেহমানদারি করার জন্য বলেছিলাম। তাঁকে জবাই করে মানুষকে খাওয়ানোর বিষয়ে বক্তব্য দিইনি।’ ভিডিওর কথা উল্লেখ করা হলেও তিনি বক্তব্যের বিষয়টি অস্বীকার করেন।
তবে ফরিদুলের বক্তৃতার সময় মঞ্চে থাকা তারেক বিন ওচমান শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জবাই করার বিষয়ে আমি শুনিনি। তবে পিটার হাসকে নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার বিষয়ে শুনেছি। এ ধরনের বক্তব্য দেওয়াটা ঠিক হয়নি। তাই ভবিষ্যতে দলীয় সভায় এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করা হবে।’
এদিকে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন আইবেলি আজ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের উদ্দেশে হুমকিমূলক বক্তব্যের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমরা বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।’
তিনি বলেন, কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় মার্কিন কূটনৈতিক মিশন ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এর আগে ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী এক সমাবেশে পিটার হাসকে প্রকাশ্যে পেটানোর হুমকি দিয়েছিলেন। ৮ নভেম্বর তা গণমাধ্যমে আসে।
এদিকে, ২৮ অক্টোবর সংঘর্ষ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্য ও যুবদল কর্মী নিহত হন। এরপর পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে তিন ডজনেরও বেশি মামলা দেয় এবং তাদের গ্রেফতার শুরু করে। দলটির মহাসচিবসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে ইতোমধ্যে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে এসব কিছুকে স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়া মনে হতে পারে। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত ‘গায়েবি’ মামলা দায়েরসহ নানারকম আইনি প্রক্রিয়ায় বিরোধী নেতাকর্মীদের দমন–পীড়ন–হয়রানির বিষয়টি বিবেচনায় রাখলে এগুলোকে এত সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই। এছাড়া এসব ঘটনার কার্যকারণ ও ফলাফল (কজ এন্ড ইফেক্ট) নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। এমনকী কোন পক্ষ সুবিধাভোগী (বেনিফেশিয়ারি) সেটাও বিবেচনাও করা হচ্ছে না। এর ফলে সহিংসতার জন্য কার দায় কতটুকু সেটা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি দলের পক্ষ থেকে ২৮ অক্টোবর সংঘটিত সহিংসতার দায় এককভাবে বিএনপির ওপর চাপানোর চেষ্টা চলছে–এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণেও তা উঠে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গত ২৮ অক্টোবর রাজনৈতিক বিক্ষোভের ওপর পুলিশ অহেতুক শক্তি প্রয়োগ করেছে। সব পক্ষ সহিংসতায় অংশ নিলেও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপরই ধরপাকড় চালানো হচ্ছে।’ (প্রথম আলো, ১ নভেম্বর ২০২৩)।
শুধু আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা ক্ষমতাসীন দল নয়, সরকার–সমর্থক সাংবাদিক এবং বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমও সহিংসতার জন্য বিএনপিকে একতরফাভাবে দায়ী করেছে। ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশস্থল থেকে একটু দূরে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক মারধোরের শিকার হন। এই ঘটনায় সরকারপন্থি সাংবাদিকরা বিএনপিকে দায়ী করে বক্তব্য দেন। (সাংবাদিকদের ওপর হামলা, বিএনপিকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমা চাওয়ার আলটিমেটাম, প্রথম আলো, ৩০ অক্টেবর)।
এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘২৮ অক্টোবর সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারকদের বাসভবনে হামলা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সেদিন আনুমানিক ৩০ সাংবাদিকের ওপর হামলা করা হয়েছে। এসব হামলায় বিক্ষোভকারীরা ছাড়াও মোটরসাইকেলে আসা মুখোশ পরা একদল ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন, যাঁরা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক বলে ধারণা করা হচ্ছে।’ (সরকারকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান, প্রথম আলো ১ নভেম্বর ২০২৩)
সহিংসতা নিয়ে সরকারপন্থি সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার বক্তব্যের মধ্যে এ পার্থক্য কেন? এ ঘটনাকে অনিচ্ছাকৃত বা অজ্ঞতাপ্রসূত বলার কোন সুযোগ নেই। তাহলে এটা কি দলীয় আনুগত্যের প্রকাশ?
আপনার মতামত জানানঃ