বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ইতিমধ্যেই দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলছে। কারণ বিরোধীরা জানুয়ারিতে প্রত্যাশিত সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে বারবার অবরোধ করছে। গত সপ্তাহে তিনদিনের ধর্মঘটের পর সোমবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কর্মীদের নেতৃত্বে দুইদিনের দেশব্যাপী ধর্মঘটের গতকাল ছিল দ্বিতীয় দিন।
বিক্ষোভ যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং সম্ভাব্য সহিংসতা এড়াতে অনেক নাগরিককে তাদের ভ্রমণ সীমিত করতে প্ররোচিত করে। অসংখ্য অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে এবং বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে এবং বিএনপি’র শত শত সদস্য ও নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলো কারচুপির অভিযোগে কলঙ্কিত হয়েছিল। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন তদারকির জন্য হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের কাছে যতক্ষণ না ক্ষমতা হস্তান্তর করছে ততক্ষণ আন্দোলন আরও বাড়তে থাকবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিরোধীরা। কিন্তু হাসিনা, যিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, গণতন্ত্র রক্ষা করছেন, হার মানতে রাজি নন। এই অস্থিরতার মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শ্রমিকরাও সাম্প্রতিক দিনগুলোতে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ করছেন।
গভীরতর রাজনৈতিক অচলাবস্থা অর্থনীতির জন্য আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে, যা ইতিমধ্যেই কোভিড-১৯ মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রভাবের কারণে মারাত্মকভাবে চাপে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির চাপ এই বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ সরকারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে ৪.৭ বিলিয়ন ঋণ চাইতে বাধ্য করে। কিন্তু যখন কিছু সংস্কার চলছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অধরা থেকে যায় এবং রাস্তার সংকট দেশের সম্ভাবনাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
ঢাকাভিত্তিক একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট’-এর সভাপতি তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির বলেছেন- ‘সামগ্রিকভাবে এটি একটি কঠিন পরিস্থিতি, তবে ঝুঁকিটা অনেকটাই বেশি। কারণ অচলাবস্থা চলতে থাকলে, আমাদের বহুস্তরযুক্ত বৈশ্বিক সংযোগ- ব্যবসা, রপ্তানি, রেমিটেন্স বা অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম আরও প্রভাবিত হতে পারে।’
জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে বাংলাদেশের ‘ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট ঘাটতি’- ইতিমধ্যেই প্রসারিত হয়েছে ২.৮ বিলিয়ন, যেখানে এর চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৯৩ বিলিয়ন। সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য দেখায়, ওগঋ-এর ব্যালেন্স অফ পেমেন্টস এবং ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (ইচগ৬) মানদণ্ডের ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রার স্টক ২০.৬৬ বিলিয়নে নেমে এসেছে। এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো অনুসারে, মার্চেন্ডাইজ রপ্তানির মাধ্যমে আয় অক্টোবরে ১৩.৬৪% কমে ৩.৭৬ বিলিয়ন হয়েছে, যা গত ২৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। জুলাই-অক্টোবর সময়ের মধ্যে রেমিটেন্স প্রবাহও ৪.৪% কমেছে।
ঢাকার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশিষ্ট ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক মৌলিক বিষয়গুলো দুর্বল। আর্থিক ভারসাম্য, বাহ্যিক খাতের ভারসাম্য এবং মুদ্রাস্ফীতির হার- এই সমস্ত বিষয় বেশ কিছুদিন ধরে চাপের মধ্যে ছিল।’ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৯%-এর কাছাকাছি অবস্থান করছে।
দেবপ্রিয় বলেছেন যে, কয়েকটি কারণ পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলছে। অর্থনীতিতে মনোযোগ ও সমন্বয়ের অভাবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন- ‘মনে হচ্ছে নির্বাচনের আগে আগামী তিন মাসে সরকার কোনো সংস্কারমূলক বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে সমাধান করতে চাইছে না। এটি এমন একটি সমস্যা যা আরও গভীর হচ্ছে।’ তার মতে, রাজনৈতিক সহিংসতা বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান উভয়ের সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করে এবং রপ্তানি পণ্য সরবরাহকেও প্রভাবিত করতে পারে।
রাজনৈতিকভাবে যাই ঘটুক না কেন, বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, সরকারের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে দেরি না করে দ্রুত সমাধান করা দরকার। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, ‘চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা স্পষ্টতই বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য ভালো খবর নয়, কারণ এটি তাদের ব্যাহত করছে।’ তিনি যোগ করেছেন যে, ‘অর্থনীতি ইতিমধ্যে ‘গুরুতর সংকট’-এর মধ্যে রয়েছে।
যেয্বএটি কাটিয়ে উঠতে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করা এবং বাহ্যিক ভারসাম্যহীনতাগুলো পরীক্ষা করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক আবহাওয়া যেদিকেই যাক না কেন, সরকারকে যে কোনো ক্ষেত্রে ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার সমাধান করতে হবে। ‘তি🎐নি পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, একটি ওভারডিউ কোর্স সংশোধনের জন্য এখনও সময় আছে, তবে যদি না নিজে থেকে সংশোধন করা হয়, এটি আরও খারাপ দিকে যেতে পারে।’
কিন্তু দীর্ঘায়িত রাজনৈতিক সংকট ডুবন্ত অর্থনীতি থেকে মনোযোগ সরিয়ে দিতে পারে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কেউই পিছিয়ে পড়ার বা আলোচনার পথে যাওয়ার লক্ষণ দেখাচ্ছে না। প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত কবির বলেন, ‘কী ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা খুবই কঠিন। মধ্যস্থতা ও অচলাবস্থা সমাধানের জন্য তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু প্রশ্ন হলো সেই তৃতীয় পক্ষ কে হবেন।’ অভ্যন্তরীণভাবে, তিনি কোনো কার্যকর ব্যক্তির সন্ধান পাননি।
আন্তর্জাতিকভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করছে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করতে পারে এমন কারও উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কবিরের মতে, ‘বিদেশ থেকে হস্তক্ষেপ কোনো উল্লেখযোগ্য সমাধান নিয়ে আসে না। তিনি নিজেও কোনো সমাধানসূত্র দিতে পারেননি। তবে একটি বিষয়ে সতর্ক করেছেন- ‘ঝুঁকিগুলো বহুগুণ বাড়ছে এবং এটি একটি জাতি হিসেবে আমাদের প্রভাবিত করবে’।
আপনার মতামত জানানঃ