আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর সাচ্চা সৈনিক বলে দাবি করেন। কিন্তু তাঁদের কথা ও আচরণে তার প্রতিফলন পাওয়া যায় না। কয়েক দিন আগে মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ফয়সাল বিপ্লব, যিনি আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা, সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসের উদ্দেশ্যে অশালীন ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক কথা বলেন।
ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ধারক একজন পৌরমেয়র ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীস্বার্থে তাঁর দলেরই একজন সংসদ সদস্যকে সাম্প্রদায়িক গালি দিলেন, আর কেন্দ্রীয় নেতারাও তা নীরবে হজম করলেন। একই কথা বিএনপি বা জামায়াতের কেউ বললে তুলকালাম ঘটিয়ে দিতেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
কুমিল্লার সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন ওরফে বাহার আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে দুর্গোৎসব সম্পর্কেই অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। তিনি তাঁর ধর্মের আচার-নীতি নিয়ে কথা বলতে পারেন। অন্যের ধর্মের অনুসারীরা কীভাবে দুর্গাপূজা পালন করবেন, সেসব নিয়ে নাক গলানোর এখতিয়ার তাঁকে কে দিয়েছে? সংসদ সদস্য হলেই অন্য ধর্মের অবমাননা করা যায় না।
শারদীয় দুর্গাপূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব। এটা তাঁরা কীভাবে পালিত হবে, তাঁরাই ঠিক করবেন। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বলে দিতে পারেন না এভাবে করতে হবে, ওভাবে করা যাবে না।
২০২১ সাল তাঁর নির্বাচনী এলাকায় দুর্গোৎসবের সময় যে তাণ্ডব হলো, তা নিয়েও রাজনৈতিক মহলে নানা গুঞ্জন আছে। দুর্গোৎসবের সময় এমপি সাহেব ওমরাহ হজ পালন করতে সৌদি আরব গেলেও তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা সবাই দেশেই ছিলেন। ঘটনার পর কুমিল্লায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয়েছিল।
তাঁরা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, যারা ভোটের সময় আমাদের আমানত ভাবেন, তাদের কাউকে হামলা প্রতিরোধে দেখা যায়নি। তাদের প্রশ্ন ছিল, যেখানে এমপি সাহেবের নির্দেশনা ছাড়া কোনো মন্দিরের কমিটি হয় না, সেখানে এ ধরনের অঘটন ঘটল কীভাবে ঘটল?
এবারে এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের বক্তব্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিবাদ করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। কুমিল্লায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুমিল্লা নগরের নজরুল অ্যাভিনিউতে বিক্ষোভ মিছিল বের করলে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ধাওয়া দেয়। ওই সময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগও পাল্টা কর্মসূচি নেয়।
এত দিন দেখতাম বিএনপি কর্মসূচি নিলে ছাত্রলীগ যুবলীগ পাল্টা কর্মসূচি নিত। এখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কর্মসূচিতেও তারা বাধা দিচ্ছে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মিছিলে বহন করা ব্যানারে লেখা ছিল ‘পূজা হোক সাত্ত্বিক পরিবেশে’।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় আচারও কি ছাত্রলীগ-যুবলীগ ঠিক করে দেবে? ২০২১ সালে কুমিল্লায় যখন সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা হলো তখন তো আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখন তারা কার লাঠিয়াল হিসেবে মাঠে নেমেছেন?
বিভিন্ন জায়গায় পূজার প্রাক্কালে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের প্রতিবাদে শুক্রবার সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেছিল হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ এবং তাদের ধাওয়া করেছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। তাহলে কি তারা সংখ্যালঘুদের মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরকে সমর্থন করেন?
ঐক্য পরিষদের কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তাপস বকশী বলেন, ‘আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে প্রথমে পুলিশ বাধা দেয়। পরে মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আমাদের মিছিলে ধাওয়া করেন। এতে এক নারীসহ অন্তত তিনজন আহত হয়েছেন। সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন দুর্গাপূজায় মদ খাওয়া নিয়ে কটূক্তি করায় আমরা কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিক্ষোভ করতে গিয়ে এ ঘটনা ঘটে।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শুক্রবার সকাল ১০টায় নগরের নজরুল অ্যাভিনিউ এলাকার রাজস্থলী মন্দির এলাকায় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অংশগ্রহণকারীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে নগরের কান্দিরপাড় পুবালি চত্বরে আসছিলেন।
এ সময় নগরের কান্দিরপাড় পুবালি চত্বর থেকে মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী মিছিলকারীদের ধাওয়া করেন। এতে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর মিছিলকারীরা রানীর বাজার ও মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা কান্দিরপাড় পুবালি চত্বরে অবস্থান নেন।
সম্প্রতি কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে পূজা উদ্যাপন নিয়ে এক সভা হয়। এ সময় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের ‘মদমুক্ত পূজা’ করার আহ্বান জানিয়ে দেওয়া একটি বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের দপ্তর সম্পাদক মিহির রঞ্জন হাওলাদার স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের বক্তব্যকে ‘সাম্প্রদায়িক উক্তি’ আখ্যা দিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়।
কুমিল্লায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কর্মসূচিতে হামলার প্রতিবাদ ও জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন পরিষদের নেতা-কর্মীরা। শুক্রবার শাহবাগ থানার সামনে তাঁরা এই কর্মসূচি পালন করেন।
ঐক্য পরিষদের পূর্বঘোষিত কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে হচ্ছিল। কর্মসূচি চলাকালে ঐক্য পরিষদের শীর্ষ নেতারা কুমিল্লায় হামলার খবর পান। কুমিল্লায় স্থানীয় সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার অনুসারীরা এই হামলা চালিয়েছেন বলে জানান তারা। পরে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে শাহবাগে যান পরিষদের নেতা-কর্মীরা।
ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, কয়েক দিন আগে মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ফয়সাল বিপ্লব আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসকে সাম্প্রদায়িক গালি দেন। অন্যদিকে ৪ অক্টোবর সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার হিন্দুসম্প্রদায়ের লাখ লাখ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। ঐক্য পরিষদ প্রতিবাদ জানালে তিনি প্রতিহত করার ঘোষণা দেন।
রানা দাশগুপ্ত ঘোষণা করেন, কুমিল্লায় হামলার ঘটনায় যতক্ষণ পর্যন্ত অন্তত একজন গ্রেপ্তার না হবেন, ততক্ষণ তাঁদের অবস্থান কর্মসূচি চলবে। এই একজন বলতে তিনি কাকে বুঝিয়েছেন, পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকার যখন নকশাল দেখামাত্র গুলি করার হুকুম দিয়েছিল, প্রবীণ নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘নকশাল কারও গায়ে লেখা থাকে না।’ তাঁর সেই কথা ঘুরিয়ে বলা যায়, ‘সাম্প্রদায়িকতাও কারও গায়ে লেখা থাকে না। আচরণেই প্রমাণ করতে হয় কে সংখ্যালঘু বান্ধব, কে সংখ্যালঘুদের বিপক্ষে।
দলের গঠনতন্ত্র কিংবা নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা লেখা থাকলেও প্রমাণ করে না, সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সংখ্যালঘুবান্ধব। লিখেছেন, সোহরাব হাসান।
আপনার মতামত জানানঃ