অত্যন্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ক্ষুদ্রঋণ চালু করে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশী অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের কাছে আইকনে পরিণত হয়েছেন। প্রচলিত ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ পাওয়া এই অতি দরিদ্রদের জন্য দুষ্কর।
কিন্তু সেই মুহাম্মদ ইউনূস এখন তার নিজ দেশ বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমানভাবে ‘নিন্দার শিকার’ হচ্ছেন এবং তাকে সম্ভাব্য কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই প্রফেসর ইউনূসকে টার্গেট করেন। ঋণ পরিশোধে বাধ্য করার জন্য তাকে ‘গরীরের রক্তচোষা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন শেখ হাসিনা।
এমনকি ২০১২ সালে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার জন্যও তিনি প্রফেসর ইউনূসকে দায়ী করেছেন।
সম্প্রতি, শ্রম আইন লঙ্ঘনের এক মামলায় বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন প্রফেসর ইউনূস। ১০ দিন আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত ইউনূসের একটি আপিল খারিজ করে দেন। এই সিদ্ধান্তের পর শ্রম আদালতে মুহাম্মদ ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের চার কর্মকর্তার বিচার চলছে।
তার মেয়ে মনিকা ইউনূস ‘সিং ফর হোপ’ নামে নিউ ইয়র্কের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের প্রধান। তিনি গত ২৮শে আগস্ট লিঙ্কডইনে এক পোস্টে বলেন, শেখ হাসিনা ইউনূসকে আগামী এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়েছেন। দোষী সাব্যস্ত হলে ইউনূসকে কমপক্ষে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হবে।
শেখ হাসিনা যখন পঞ্চম মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের অপেক্ষায় আছেন, তখনই এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনুমান করেন যে, ২০০৬ সালে প্রফেসর ইউনূসের নোবেল জয় এবং ২০০৭ সালে তার একটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল গঠন শেখ হাসিনাকে ক্ষুব্ধ করেছে। এখন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার সেই ক্ষোভ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
ড. ইউনূসকে হয়রানির ইতিহাস
২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। ২০১১ সালে অবসরের বয়স সংক্রান্ত বিধিমালার কারণে ইউনূসকে নিজের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে জোরপূর্বক অপসারণ করা হয়। তিনি এটিকে চ্যালেঞ্জ করে আইনি লড়াই শুরু করেছিলেন, কিন্তু এতে তিনি হেরে যান।
২০১৩ সালে ইউনূস আবারও বিচারের মুখোমুখি হন। তার বিরুদ্ধে সরকারের অনুমোদন ছাড়া বিদেশ থেকে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ আনা হয়।
সেপ্টেম্বর ২০২১-এ ইউনূস সহ গ্রামীণ টেলিকম নির্বাহীদের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলা দায়ের করা হয়। মে ২০২৩-এ বাংলাদেশের হাইকোর্ট আদেশ দেয় যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ১২ কোটি টাকার বেশি আয়কর দিতে হবে। দান করা টাকার বিপরীতে ওই আয়কর দাবি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
সেটিকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে আবেদন করেছিলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ। তবে ইউনূসের দায়ের করা আবেদন খারিজ করে দেয় হাইকোর্ট।
আগস্ট ২০২৩-এ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলার বিচার শুরু হয় ২২শে আগস্ট। গ্রামীণ টেলিকম কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, সংস্থার ১০১ জন কর্মচারীর চাকরি স্থায়ী করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি এবং শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। ১৮ জন প্রাক্তন গ্রামীণ টেলিকম কর্মচারীও ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
সম্প্রতি শেখ হাসিনার কাছে লেখা একটি খোলা চিঠিতে প্রফেসর ইউনূসের ওপর ‘নিরবিচ্ছিন্ন বিচারিক হয়রানি’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বের ১৭৬ সুপরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
এর মধ্যে আছেন ১০০ জনেরও বেশি নোবেল বিজয়ী, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুন। চিঠিটিকে ৩১শে আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমসের আন্তর্জাতিক সংস্করণে একটি পূর্ণ-পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন হিসাবে প্রকাশ করা হয়।
এর আগে গত মার্চ মাসেও প্রফেসর ইউনূসের পক্ষে বিশ্ব নেতাদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল ওয়াশিংটন পোস্টে। একজন বাংলাদেশী মন্ত্রী অনুমান করেছিলেন যে, এ জন্য ব্যয় করতে হয়েছিল এক মিলিয়ন ডলার!
তবে হিসেব করে দেখা গেছে ওয়াশিংটন পোস্টের একটি এ-সেভেন পাতার বিজ্ঞাপনে খরচ হয় ৮৩ হাজার ৪৩০ ডলার। যদিও ‘প্রোটেক্ট ইউনূস ক্যাম্পেইন’ জানিয়েছে, তারা ওই বিজ্ঞাপন ছাপাতে ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে বড় ডিস্কাউন্ট পেয়েছিল।
বাংলাদেশের নির্বাচনের উপর নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র
গত মে মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য এমন পদক্ষেপ নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
ওই নীতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারপন্থী রাজনৈতিক দল, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্য সহ দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এমন যেকোনো বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৪৫
আপনার মতামত জানানঃ