“আপনারা তাদের চরিত্র জানেন। তারাতো সন্ত্রাসী” — প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সম্পর্কে সম্প্রতি এই মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপি হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছে।
পুলিশি বাধা, আওয়ামী লীগ-পন্থী মাস্তানদের সহিংসতা ও শাসক দলের পাল্টা সমাবেশ সত্ত্বেও আন্দোলনের অংশ হিসেবে দলটি ধারাবাহিক সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ঢাকার রাজনৈতিক উত্তাপও অনেক বেড়েছে।
বিএনপি চায় একটি তত্বাবধায়ক সরকার ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠেয় আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করুক। কিন্তু হাসিনা এই দাবি মানতে নারাজ। একদিকে আওয়ামী লীগের করায়ত্তে দেশের সমগ্র প্রশাসনযন্ত্র, অপরদিকে বিএনপির পক্ষে ক্রমশই বাড়তে থাকা জনমত — ক্ষমতার ভারসাম্যটাই এখন এমন যে এক ধরণের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
তবে এসব বাংলাদেশে অভাবিততো নয়ই, বরং পুরো পরিস্থিতি দেখে দেজা ভ্যুর অনুভূতি জন্মায়। কিন্তু এই ধরণের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি আগে থেকে ঠাওর করা গেলেও, এখানে ঝুঁকিটা হলো যে, এসব পরিস্থিতি যেকোনো সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
বিএনপির আন্দোলন সবসময় শান্তিপূর্ণ থাকবে তার নিশ্চয়তা যেমন নেই, হাসিনার ক্ষমতাদুর্গের স্থায়ীত্বও তেমনই অনিশ্চিত। অগ্নিকাণ্ডের শিকার হওয়া বাস, ভুয়া সংবাদ-কেন্দ্রিক অপপ্রচার, দলে দলে হানাহানি ও গণগ্রেপ্তার বৃদ্ধির পাশাপাশি উন্মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে হাসিনার উপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান মিত্র দেশগুলোর কূটনৈতিক চাপ যেভাবে বাড়ছে, সেই বিবেচনায় এটি অনুমেয় যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ নয়।
যেহেতু দুই দল একমত না হলে কোনো তত্বাবধায়ক সরকারের উদ্ভব সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে, দুই দল যদি কখনোই একমত হতে না পারে, তাহলে কী ঘটবে? হাসিনা হয়তো বিএনপির প্রতি আরও কঠোর হয়ে উঠতে পারেন।
এতে যদি গণঅভ্যুত্থান নাও ঘটে, আরও একটি বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিভিন্ন ঘরানার আওয়ামী লীগ-বিরোধী শিবিরে পাল্টা সশস্ত্র প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে।
আরেকটি সম্ভাবনা হলো অচলাবস্থা থেকে হতাশা তৈরি হলে বিএনপি জোরজবরদস্তিমূলক পদ্ধতি পরখ করে দেখতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। হাসিনা কিন্তু ঠিক তাই চান, কারণ সেক্ষেত্রে তিনি বিএনপির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যা বলেছেন (“তারা তো সন্ত্রাসী”), সেটিই সঠিক প্রমাণিত হবে। এখন পর্যন্ত বিরোধীরা সেই ফাঁদে পা দেয়নি, কিন্তু তার ব্যত্যয় ঘটতেই পারে।
আর সেই ধরণের গোলযোগের ঝুঁকি যে আছে — তা তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের জন্য যথেষ্ট না হলেও একটি দরকারি উপাদান।
যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের সমৃদ্ধ ও সাম্প্রতিক ইতিহাস রয়েছে, তাই এই সম্ভাবনা নিয়ে গভীরভাবে ভাবা দরকার। এ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে তত্বাবধায়ক কোনো কাঠামোর সহায়তায় আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত দায়িত্ব, কিংবা একতরফাভাবে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের কাজ সেনাবাহিনী ভালোভাবেই করতে পারবে।
কিন্তু সমস্যা হলো, এ জন্য যে ধরণের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হবে, তা কোনো ঐক্যমত্যের উপর নির্ভরশীল নয়। ঐক্যমত্য থাকলে সেনাবাহিনী কেবল একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে মাঠে থাকে। কিন্তু যখন বিদ্যমান স্বাভাবিক পরিস্থিতি ভেঙ্গে পড়ে, তখনই ওই ধরণের হস্তক্ষেপ ঘটে, যেটি কিনা পূর্বানুমান করা কঠিন; অগণতান্ত্রিক তো বটেই।
ঠিক কী পরিস্থিতি ঘটলে সেনাপ্রধান এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ হস্তক্ষেপ করার কথা বিবেচনা করতে পারেন? মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বহুলপ্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে, এই মুহূর্তে এই ধরণের হস্তক্ষেপের বিষয়টি অচিন্তনীয় না হলেও, এর সম্ভাবনা খুব কম।
কিন্তু সেনাপ্রধান যা আজ পরিকল্পনা করতে বা কল্পনাও করতে পারছেন না, তিনি যে কয়েক সপ্তাহ পরও তা পারবেন না — এমন নাও হতে পারে। তাই নির্বাচনী অচলাবস্থা ব্যাতিত, আর কী কারণে তার সমীকরণ পাল্টে যেতে পারে?
এখানে তিনটি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া যাক: প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ, পেশাদারিত্ব ও ভারতের প্রতিক্রিয়া। ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের পর যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরত গেল, তারপর থেকেই তাদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ আর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ব্যাক্তিগত স্বার্থ হাসিনার ভাগ্যের সঙ্গে মিশে আছে।
লোভনীয় প্রতিরক্ষা কেনাকাটার চুক্তি থেকে শুরু করে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচি থেকে প্রাপ্ত আর্থিক সুবিধাদি আর বহিঃশক্তির অনুপস্থিতি — সব মিলিয়ে রাজনীতির বাইরের সময়টা সেনাবাহিনীর জন্য উপভোগ্যই ছিল।
এর সঙ্গে যোগ করুন মানবিক কোনো সংকটে সবার আগে তাদের এগিয়ে আসার সফলতা ও সুনাম, আর তখনই এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে কেন সেনাবাহিনী ব্যারাকে থাকতেই বেশি পছন্দ করবে।
কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট এই সাম্যাবস্থায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। প্রতিরক্ষা কেনাকাটায় ভাটা পড়েছে — ফলে হাসিনা আর কত দিন দিয়ে যেতে পারবেন, সেই সামর্থ্য নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে অস্বস্তি দানা বেঁধেছে। কেউ হয়তো যুক্তি দেখাতে পারেন যে, চিরজীবন নিরবিচ্ছিন্ন সুখ আশা করা তো ঠিক নয়।
কিন্তু যখন সাংবিধানিক সংহতির বদলে অভিজাতদের দুর্নীতি ও পরিবার-নির্ভর পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র বিনির্মিত হতে থাকে, তখন এই ধরণের প্রত্যাশাই হয়ে উঠে স্বাভাবিক। আর সুবিধা-হারানোর অনুভূতি আরও প্রকট হয়ে উঠে যখন আপনি এর সঙ্গে যোগ করবেন মধ্যম-সারির কর্মকর্তাদের মধ্যে রোহিঙ্গা ঠেকাতে না পারার অপমানের অনুভূতি।
তাই এটি বিস্ময়কর নয় যে, মালি থেকে জাতিসংঘ নিজেদের শান্তিরক্ষা বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়ার পর সেখানে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি ক্রমেই অসন্তোষে রূপ নিয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্ব।
শফিউদ্দিনকে সম্মানের চোখে দেখা হয় কারণ তাকে একজন কার্যকর ও উচ্চাবিলাশি বাহিনীপ্রধান হিসেবে ভাবা হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচনের অল্প সময় পরই তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। অর্থাৎ, আগামী কয়েক মাসে তিনি কী করবেন, তার উপরই নির্ভর করছে তার লিগ্যাসি।
এখানে আবার সেনাপ্রধানের কার্যালয় ও হাসিনার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব:) তারিক সিদ্দিকীর — যিনি আবার শেখ রেহানার স্বামীর ছোট ভাই — মধ্যকার সংবেদনশীল ভারসাম্যের বিষয়টি সামনে চলে আসে। শফিউদ্দিনের যেখানে রয়েছে পেশাদারিত্বের সুনাম, সিদ্দিকীর ইমেজ সেখানে দুর্নীতির অভিযোগে কর্দমাক্ত।
যদি হাসিনার কর্মকাণ্ডের কারণে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি — হোক বাস্তবে বা কল্পনায় — ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে সেনাবাহিনী হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক পেশাদারিত্ব রক্ষার জন্য হস্তক্ষেপ করতে পারে। এক্ষেত্রে দোহাই দেওয়া হতে পারে সাংবিধানিক সংহতি রক্ষার, যা হবে স্ববিরোধী।
সর্বশেষ আরেকটি বিষয়ও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো, ভারতের প্রতিক্রিয়া।
বাংলাদেশে যে বিষয়টি খুব ভালোভাবে জানা নেই তা হলো সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে গিয়েছিল ভারতের চাপে। ২০০৯ সালে যখন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উদ্দিন আহমেদকে তার অধীনস্থ কর্মকর্তারা বিডিআর বিদ্রোহ দমনে গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে চাপ দিচ্ছিলেন, ভারত তখন সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়েছিল।
নয়া দিল্লি তখন হাসিনার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল এবং মঈনের নেপোলিয়ানসম উচ্চাবিলাস নিয়ে অনিশ্চিত ছিল। আর ভারতের হুমকি কেবল নিছক হুমকি ছিল না।
ভারতের কারণে হাসিনা রাজনৈতিকভাবে তখন পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছিলেন এবং সামরিক বাহিনীর চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। এরপর থেকে তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
কিন্তু বাংলাদেশের সামরিক-বেসামরিক ভারসাম্য চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে টলে উঠলে, ২০০৯ সালের নীতিমালা ঠিক ছিল কিনা, তার দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন তৈরি হতে পারে। আর সেক্ষেত্রে পুরো উপমহাদেশ এমন এক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হতে পারে, যেখানে আগে কেউ যায়নি। সূত্র: নেত্র নিউজ।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৪৫
আপনার মতামত জানানঃ