টানা চার দশকের বেশি সময় ধরে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে চীন। দেশটি এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। কিন্তু কোভিড মহামারিসহ অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে পড়ে চীনের অর্থনীতি চরম দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
চীনে দ্রুত প্রবৃদ্ধি এনে দেওয়া অর্থনৈতিক মডেলটি ‘ভেঙে পড়ছে’ বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে।
অর্থনীতিবিদদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, চীনের অর্থনৈতিক সংকট দেশটির সামগ্রিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে। সংকট এতই গভীর যে চীনের অর্থনীতি ধীর প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করছে।
এর কারণ, চীনের এখনকার জনমিতি প্রবৃদ্ধি সহায়ক নয় এবং দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলোর বিভক্তি বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে চীনের বিদেশি বিনিয়োগ ও বাণিজ্য ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল বলছে, চীনের এই অর্থনৈতিক দুর্বলতা কেবল অল্প কয়েকটি বছর নয় বরং দীর্ঘমেয়াদি হতে যাচ্ছে। ‘দেশটির (অর্থনৈতিক) মডেল ভেঙে পড়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক এবং অর্থনৈতিক সংকটের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ অ্যাডাম তোজিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘আমরা অর্থনীতির ইতিহাসের গতিপথে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। এটি হতে পারে সবচেয়ে নাটকীয় মোড়।’
ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে চীনের সরকারি-বেসরকারি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দেশটির মোট জিডিপির ৩০০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
২০১২ সালে দেশটির মোট ঋণ ছিল জিডিপির ২০০ শতাংশ বেশি। চীনের শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই বলছেন, গত কয়েক দশক ধরে যে মডেল অনুসরণ করে প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল, তা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে গেছে।
এর আগে গত বছর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণে অতিমাত্রায় ঋণনির্ভরতার কড়া সমালোচনা করেন প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং।
তিনি বলেন, ‘কিছু লোক মনে করেন, উন্নয়ন মানে বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা এবং বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলা।’ চীনের পুরোনো মডেলের অর্থনীতির থেকে যে সি সরতে চান না তা খুব দৃশ্যমান।
চীনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের (এনবিএস) তথ্য অনুযাী, চলতি বছরের প্রথমার্ধে চীনের জিডিপি আগের বছরের একই সময়ের সাড়ে ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে।
জুন পর্যন্ত চীনের জিডিপির পরিমাণ ছিল ৫৯ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ৮ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার)। তবে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) জিডিপি ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হারে বেড়েছে বলে এনবিএস জানিয়েছে।
এদিকে অর্থনীতিকে চাঙা করা লক্ষ্যে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছর মেয়াদী ঋণের সুদহার ১০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নির্ধারণ করেছে। তবে পাঁচবছর মেয়াদী ঋণের সুদের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশে অপরিবর্তিত রেখেছে।
চলতি বছরের শুরু থেকেই বেইজিং ‘ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং’ বাতিল করছে, আস্থা লঙ্ঘনের দায়ে টেক কোম্পানিগুলোকে করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার জরিমানা। যেসব কোম্পানি চীনের কারিগরি শিক্ষাখাতে এতদিন বিনিয়োগ করে বড় অঙ্কের মুনাফা তৈরি করছিল, সেসব কোম্পানিগুলোকেও জোরপূর্বক বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।
আরও ভয়ানক কথা হলো, চীনের দ্বিতীয় বৃহতম রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার গ্রুপ ‘এভারগ্রান্ড’ সম্প্রতি তার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। চীনের এই ঘটনা শঙ্কিত করে তুলেছে পুরো বিশ্ব অর্থনীতির বাজারকে। অনেকেই চীনের অর্থনৈতিক মডেলে আবারও নতুন ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভবনা খুঁজে পেয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, অর্থনীতিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে চীন হয়তো এখন তার অনেক প্রাইভেট কোম্পানিকেই অর্থনৈতিক সমর্থন দেবে না।
কয়েক দশক ধরে চীন সস্তা শ্রম এবং সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ঋণের উপর নির্ভরশীল। ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে কোম্পানিগুলো তা ব্যয় করেছে বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট, কারখানা, সেতু ও অন্যান্য বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে। আর এখন সময় এসেছে এইসব ঋণ পরিশোধের। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের পরিবর্তে ভোক্তা ব্যয়ের মাধ্যমে অর্থনীতি পরিচালনার সক্ষমতা এখনও তৈরি হয়নি দেশটির। জনগণের আয় এবং সামগ্রিক ঋণের পরিমাণে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। ফলস্বরূপ, চীন নিজের ঋণ ফাঁদে নিজেই আটকে পড়েছে।
চীন সরকার এখন দেশের রিয়েল-এস্টেট ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করেই এই সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সরকারের এই চেষ্টায় দেশের প্রবৃদ্ধি নেমে আসবে কিছুটা ধীর গতিতে।
এছাড়া আরেকটি শঙ্কার বিষয় হলো, বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটে চীনে কয়লার দাম হয়েছে আকাশচুম্বী। সেইসঙ্গে কর্মক্ষম জনসংখ্যার যে অংশ কয়েক বছরের মধ্যে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অংশে পরিণত হতে চলেছে, তাদের পরবর্তী জীবনযাত্রার জন্য নেই পর্যাপ্ত সঞ্চয়।
এসডব্লিউএসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ