মানুষ লিখতে শুরু করে আজ থেকে সাত হাজার বছর আগে। সবচেয়ে প্রাচীনতম সভ্যতা সুমেরীয়রা নিজেদের দৈনন্দিন ব্যবসায় বাণিজ্যের হিসাব রাখতে গিয়ে লেখার জন্ম দেয়। জন্ম হয় কিউনিফর্ম লেখার পদ্ধতি। এগুলো লেখা হতো এক ধরনের মাটি দিয়ে তৈরি ট্যাবলেটে।
হিসাব রাখার ট্যাবলেট ছিল মানুষের প্রথম বই। এমন ট্যাবলেট ফরম্যাটে লেখার এক হাজার বছর পর মিসরীয়রা আবিষ্কার করল প্যাপিরাস। সেখানে তারা লিখে রাখত রাজ ফরমান থেকে পিরামিডের কথা। কিন্তু তাদের এবং সুমেরীয়দের ট্যাবলেট লেখাকে বই বলা যায় না, টেক্সট বলা যায় হয়তো।
এই বিচারে প্যাপিরাসের এক হাজার বছর পর গিলগিমাসের এপিক কাহিনী লিপিবদ্ধ ছিল প্রথম বইয়ের গল্প। সাহিত্যের পথ ধরেই বইয়ের যাত্রা। এরপর গ্রিক রোমানদের হাতে প্যাপিরাসের রোলের সাথে বাঁশ, কাঠ, হাড়, পাথর, মাটি এবং সবচেয়ে বেশি লেখা হতো চামড়া, যা পার্চমেন্ট নামে পরিচিত ছিল। গ্রিক প্লেটো এরিস্টটলের হাত ধরে রোমান সিসেরো, অরেলিয়াস, সিজারের সময়ে বুক কালচার সভ্যতায় সবচেয়ে বেশি কদর পায়।
খ্রিষ্টের পরবর্তী সময়ে ইউরোপ তখন চামড়ায় লিখত, ল্যাটিন আমেরিকার সভ্যতা তখন লিখতেই জানত না, মধ্যপ্রাচ্যের আরব সংস্কৃতিতে লেখার প্রচলন বলতে গেলে ছিলই না, মুখে মুখে তারা যতটুকু পারত মনে রাখত, এশিয়ার উপমহাদেশে লেখার উপকরণ ছিল বাঁশ, তালের পাতা, পাথরে, তখন একমাত্র চীনারাই প্রথম কাগজ তৈরি আবিষ্কার করল খ্রিষ্ট-পরবর্তী ১০০ সালের পর।
কাগজ আছে, কলম আছে, হরফ আছে, কিন্তু কাগজের প্রথম বই হতে সময় নিলো আরো ৫০০ বছর। ৬০০ শতাব্দীর দিকে চীনারাই প্রথম কাগজের বই বের করল হাতে লিখে।
চীনের কাগজ এসে গেছে ইউরোপে ততদিনে। কিন্তু সেই ইউরোপ ৮০০ বছর পর ’১৫ শতাব্দীতে জন্ম নিলো প্রিন্টিং প্রেস। জার্মানির গুটেনবার্গ জন্ম নেয়া গুটেনবার্গ প্রেস জন্ম দিলো কাগজে প্রিন্ট হওয়া প্রথম বই গুটেনবার্গ বাইবেল।
৬০০ বছর হয়ে গেল। ছাপার হরফে বইয়ের ধাপ পেরিয়ে এলো আধুনিক বুক বাইন্ডিং ’১৮ শতকে। তারপর থেকে গত ২০০ বছর বইয়ের ধরন, উপকরণ একই রকম রয়ে গেছে এবং চলছে।
একুশ শতকে বিশ্ব বইয়ের বাজার কেমন! কেমন চলছে বইয়ের সংসার এই শতকে। দেশ হিসেবে বছরে সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশ করে চীনারা। দেড়শ’ কোটি মানুষের দেশ চায়নায় বছরে প্রায় পাঁচ লাখ বই বের হয় ম্যান্ডারিন এবং ক্যান্টনি ভাষায়। চায়নায় ২৯৭টি ভাষা আছে। ৫৬টি এথনিক গ্রুপ এই ভাষাগুলোতে কথা বলে। তার মধ্যে ৯০ শতাংশই দুটি ভাষায় কথা বলে। ম্যান্ডারিন এবং ক্যান্টনি। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোক আবার এই ম্যান্ডারিন ভাষায় কথা বলে।
জগতের দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাষা অনেকেই মনে করে ইংরেজি। না, স্প্যানিশ দ্বিতীয় এবং মাতৃভাষা হিসেবে ইংরেজি তৃতীয়। তবে ইংরেজি কমবেশি জানে সবচেয়ে বেশি, যা প্রায় দুই বিলিয়ন। আবার ভাষার দিক থেকে বই প্রকাশে ইংরেজি ভাষায় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বই বের হয়।
দেশ হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে আছে আমেরিকা। ৩২ কোটি মার্কিনির দেশে আমেরিকানরা বছরে তিন লাখ বই প্রকাশ করে। তৃতীয় স্থানে মাত্র ছয় কোটি মানুষের দেশে ইউনাইটেড কিংডম বা যুক্তরাজ্য বছরে বই আনে বাজারে দুই লাখ।
সে হিসাবে মাথাপিছু সবচে বেশি বই প্রকাশ করে ইংল্যান্ড। মাথাপিছু আয়ে পৃথিবীর এক নম্বর ধনী দেশ কাতার, বছরে মাত্র হাজার খানেক বই বের করে!
জাপানিরা বছরে দেড় লাখ বই প্রকাশ করে। সেদিক থেকে ইন্ডিয়াতে ১০০ কোটি মানুষ ২০টি ভাষাতে বছরে বই বের করে মাত্র ৮০ হাজার। রাশিয়া এক লাখের মতো। ইউরোপে ফ্রান্সের চেয়ে জার্মানিতে বই বের হয় বেশি। যদিও অনেকে ধারণা করে ফ্রেঞ্চ ভাষায় বেশি। তবে ’২০ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ছিল ইংরেজি নয়, ফ্রেঞ্চ ভাষা। তখন ইউরোপের রাজা, রাজন্যরা ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলত এবং ফ্রেঞ্চ ভাষায় তখন ইউরোপে সবচেয়ে বেশি বই বের হতো। ইংরেজির আক্রমণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তা কমে যেতে থাকে। জার্মানি এবং ইতালিতে গড়ে ৬০ হাজার বই বের হয় বছরে। আরব দেশগুলোর মধ্যে মিসরে সবচেয়ে বেশি বের হয়। হাজার দশেকের মতো বছরে।
পৃথিবীতে এ যাবৎ প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আনুমানিক ধরা হয় ২৫ বিলিয়নের মতো। তবে গুগলের বুক প্রজেক্টের হিসাব মতে, ওঝইঘ আছে এই পর্যন্ত আনুমানিক ১৩০ মিলিয়ন বই প্রকাশিত হয়েছে সারা বিশ্বে গত ৬০০ বছরে। ২৫ বিলিয়নের হিসাবটা একটু বেশি মনে হয় তাহলে!
বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় দুই মিলিয়ন বই প্রকাশিত হয় বছরে। দুই মিলিয়ন কপি নয়, দুই মিলিয়ন বইয়ের নাম। তবে কপি হিসাবে বছরে বিক্রি হয় প্রায় ৬০০ মিলিয়ন কপি। কপির দিক থেকে মার্কিনিরা সবচেয়ে বেশি বই কিনে। আবার গড় পড়ার দিক থেকে আশ্চর্যজনকভাবে সবচেয়ে এগিয়ে ইন্ডিয়া। সপ্তাহে ১০ ঘণ্টা বই পড়ে ইন্ডিয়ানরা। দ্বিতীয় স্থানে আরো আশ্চর্যের থাইল্যান্ড। থাইরা ৯ ঘণ্টা পড়ে সপ্তাহে। তৃতীয় চায় না।
বাংলাদেশে বছরে ছয় হাজার বই বের হয় গড়ে। মাথা আমাদের ১৮ কোটি। এই ছয় হাজার বইয়ের দুই-তৃতীয়াংশ বা সাড়ে চার হাজারের মতো বই এক মাসে বের হয়। অমর একুশে বইমেলায়।
১৮ কোটি মানুষের দেশে আশি ভাগ বই এক মাসে বের হয়। বছরে বিক্রির ৭০ শতাংশ বই আবার ওই এক মাসেই বিক্রি হয়। পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে প্রায় ২০০টির বেশি সারা বছর কাজ করা প্রকাশনী আছে। তার চেয়ে বেশি আছে মওসুমি প্রকাশনী। ওগুলো কেবল বইমেলার সময় জীবিত হয়ে ওঠে। ১৮ কোটি মানুষের দেশে জীবিত-মৃত লেখকদের সংখ্যা হাজার দশেকের মতো।
চীনারা দুই হাজার বছর আগে কাগজ আবিষ্কার করেছিল। সে কাগজ বানাতে ইউরোপীয়রা শিখেছে এক হাজার বছর পর। তার ৫০০ বছর পর ইউরোপ ছাপাখানা আবিষ্কার করল ’১৫ শতকে। তার ৪০০ বছর পর বাংলাদেশের প্রথম ছাপাখানা বসেছিল রংপুরে, ১৮৪৭ সালে। তার পরের বছর ১৮৪৮ সালে ঢাকার চকবাজারে ছাপাখানা বসে। সেই শুরু।
পরবর্তীতে পুরান ঢাকার ইসলামপুর এবং সাতচল্লিশের পর বাংলা বাজার ঘিরে প্রকাশনী ব্যবসা গড়ে ওঠে। এখনো প্রকাশনীর রাজধানী বাংলা বাজার।
পাকিস্তানের আইয়ুব খানের আমলে ১৯৬২ সালে বই প্রকাশের সহায়ক সংস্থা হিসেবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হলেও তারা এত বছরে বই প্রকাশে তেমন কিছু করেনি। এই কাজটি এখন করছে বাংলা একাডেমি। যদিও বাংলা একাডেমির কাজ বই দেখা নয়, ভাষার দেখাশোনা করা।
এখন ই-বুকের যুগ। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। এখন ভিডিও ইউটিউবের যুগ। গত পাঁচ হাজার বছর সভ্যতার বিকাশে বই ছিল সবচেয়ে বড়ো ফুয়েল। প্রিন্টিং বইয়ের সময়কাল যদিও মাত্র ৬০০ বছর। সাধারণ জনগণের হাতে বই আসার সময় মাত্র ২০০ বছর।
বইয়ের বাণিজ্যের বাজার ১০০ বছরের কম। সুতরাং প্রিন্টিং বই এত সহজে হারাবে না। ডিজিটাল বই যেমন বাড়বে, পাশাপাশি প্রিন্টিং বইয়ের এক শ্রেণীর পাঠক থাকবে এবং সেটাও কমতি বাড়তি তে থাকবে। বই হারিয়ে যাবে না। কারণ, বই হলো সভ্যতার আলোকবর্তিকা।
এসডব্লিউএসএস/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ