সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হতে প্রেরিত অত্যন্ত গোপনীয় ও স্পর্শকাতর সাইফার বার্তা ফাঁস হবার পর সরকারের উপর মহল নড়েচড়ে বসেছে। সাইফার কেলেঙ্কারিকে সংশ্লিষ্ট সকলে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করছেন। কিভাবে এ ঘটনা ঘটল তা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটির সচিব জনাব খোরশেদ আলমের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। অভিযোগ উঠেছে যে, গোপনবার্তা ফাঁসের ঘটনার মূল সন্দেহভাজন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরের মহাপরিচালক এমদাদুল ইসলাম চৌধুরীকে বাঁচানোর জন্য একটি মহল জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
স্পর্শকাতর গোপন বার্তা ফাঁসের কয়েকদিনের মধ্যে এমদাদকে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে পদায়ন করা হয়েছে। অচিরেই এই অভিযুক্ত কর্মকর্তা দেশ ত্যাগ করবেন বলে জানা গেছে। সাইফার কেলেঙ্কারিতে কয়েকজন নিরীহ কর্মচারীকে বলির পাঠা বানানোর চেষ্টা চলছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএসকে কোন অভিযোগ ছাড়াই ইতোমধ্যে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার ফরেনসিক বিশ্লেষণে অভিযোগের তীর সুস্পষ্টভাবে মহাপরিচালক এমদাদ চৌধুরীর দিকে ছুঁড়লেও অদৃশ্য হাতের ইশারায় তাকে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে পাঠানোর মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই জনাব এমদাদকে মন্ত্রণালয় থেকে রিলিজ করার প্রক্রিয়ায় অফিসারদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান যে, এমদাদকে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে পদায়নের মাধ্যমে গত ১৫ নভেম্বর ২০২১ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত পদায়ন নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে। কারণ পদায়ন নীতিমালা অনুযায়ী, ক, খ, গ, ঘ গ্রুপের মিশনের মধ্যে একজন কর্মকর্তা কোন অবস্থাতেই একই গ্রুপের দেশে দু’বার পদায়িত হবেন না। অথচ এমদাদ ইতোমধ্যে ওয়াশিংটন ও জেনেভা’স্থ বাংলাদেশ মিশনে কাজ করেছেন এবং এবার তাকে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে পদায়ন করা হয়েছে যা উল্লিখিত নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
মন্ত্রী মোমেনের আরেক ঘনিষ্ঠ সহচর বলে বিবেচিত ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা ফারুক হোসেন কে প্রথমে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্টের অফিসে এক বছরের জন্য নিয়োগ প্রদান করা হয় এবং এক বছর পর ফারুক হোসেনের ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে পদায়ন করা হয় এবং সম্প্রতি তাকে টরোন্টস্থ বাংলাদেশ কনসু্লেটের কনসাল্ জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেযা হয় যা নজিরবিহীন এবং পদায়ন নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বারবার পোস্টিং নীতিমালা লঙ্ঘনের কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ বিরাজমান।
পদায়ন নীতিমালা অনুযায়ী, ক, খ, গ, ঘ গ্রুপের মিশনের মধ্যে একজন কর্মকর্তা কোন অবস্থাতেই একই গ্রুপের দেশে দু’বার পদায়িত হবেন না। অথচ এমদাদ ইতোমধ্যে ওয়াশিংটন ও জেনেভা’স্থ বাংলাদেশ মিশনে কাজ করেছেন এবং এবার তাকে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে পদায়ন করা হয়েছে যা উল্লিখিত নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
উল্লিখিত ঘটনাগুলোর নেপথ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে বিবেচিত এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পরিচয় দানকারী লস এঞ্জেলেসে নিযুক্ত কনসাল জেনারেল সামিয়া আনজুমের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই সামিয়া আনজুম একসময় বিএনপি’র পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তার প্রতিষ্ঠান এবি ব্যাংকে চাকুরি করতেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরে মহাপরিচালক হিসেবে এমদাদের নিয়োগ দান এবং বর্তমানে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে পদায়নের মাধ্যমে নিরাপদে তার প্রস্থানের পেছনে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ’জন বলে বিবেচিত সামিয়া আনজুমের বিতর্কিত ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন।পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের ঘনিষ্ঠজন বলে বিবেচিত সামিয়া-তৌহিদ সিন্ডিকেট মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি ফাইলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে হস্তক্ষেপ করছে বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তৌহিদুল ইসলাম বর্তমানে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
এই চক্রটি পররাষ্ট্র সচিবের বিভিন্ন প্রস্তাব এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে এবং এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বিভিন্ন পর্যায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন বলে জানা গেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পোস্টিং, প্রমোশন এবং দপ্তর বন্টনের ক্ষেত্রে সামিয়া আনজুম এবং তৌহিদুল ইসলামের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে। এই সিন্ডিকেট অনেক মেধাবী কর্মকর্তাকে বিভিন্নভাবে অভিযুক্ত ও কোনঠাসা করেছে যা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। অনেক ক্ষেত্রেই ভালো পোস্টিং, প্রমোশন এবং দপ্তরের জন্য আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, সিঙ্গাপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে মিলানে কনসাল জেনারেল হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। ইতোপূর্বে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার নাম প্রস্তাব করা হলেও নেদারল্যান্ডস সরকার তাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে গ্রহণ করেনি। এরপর অস্ট্রিয়ায় তাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রস্তাব করা হলেও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগের কারণে অস্ট্রিয়া সরকার তাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে গ্রহণ করেনি। তখন নজিরবিহীনভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন তার পক্ষে সাফাই গেয়ে অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তাকে গ্রহণের জন্য অনুরোধ করে পত্র প্রেরণ করেন। অস্ট্রিয় সরকার সেই অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করেন। নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগের কারণে তৌহিদুল ইসলামের পক্ষে ইউরোপের কোন দেশেই রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ লাভের সম্ভাবনা নেই বলে সবাই মনে করেন। তবে এমন একজন ব্যক্তি কিভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা হলেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন তার পক্ষে সাফাই গান সেই বিষয়ে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
সিন্ডিকেটের বিতর্কিত ভূমিকা এবং অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং অনেক কর্মকর্তা গুরুতর অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। মাহমুদুল ইসলাম নামে এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করার সময় দূতাবাসের ব্যাংক একাউন্ট থেকে প্রায় দেড় লক্ষ ডলার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ থাকলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মারিজুয়ানা কাণ্ডে অভিযুক্ত বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কাজী আনারকলির বিরুদ্ধেও এখনো পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অবিলম্বে এদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত বলে সকলে মনে করছেন। একই সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে অযাচিত হস্তক্ষেপ কারী সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়া জরুরি মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সকলে।
বহু বছর যাবত চলমান এসব অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতার কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হতাশা পুঞ্জীভূত হতে হতে পরিস্থিতি এমন যে, তাঁরা যে কোন সময় বিদ্রোহ ঘোষণার মত কান্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারেন।
আপনার মতামত জানানঃ