এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে জীববিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল না যে, বিশ্বের প্রাচীনতম প্রাণী কে বা কারা। বিশেষ করে প্রায় ৫০ কোটি বছর আগে সুপ্রাচীন মহাসাগরে প্রথম কোন প্রাণীটা উদিত হয়েছিল। দেখতেই বা কেমন ছিল।
সম্প্রতি জিনোম তুলনা ও ক্রোমোসোমাল বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এ বিতর্কের কিছুটা অবসান করেছেন বলা যায়। তারা বলছেন, পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাণীটি হচ্ছে ‘কম্ব জেলি’ বা টিনোফোর। আর তা থেকেই এসেছেন তাবৎ প্রাণীকূল।
বর্তমান প্রাণীদের নিয়ে জিনোম বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দুটি গ্রুপে এসে ঠেকেছিলেন। যার একটি ছিল স্পঞ্জ; কিন্তু ওই স্পঞ্জ তাদের জীবন এক জায়গাতেই কাটিয়ে দেয়। ওরা সমুদ্রের পানি থেকে খাদ্য ফিল্টার করে। তবে কম্ব জেলি খাদ্যের খোঁজে সমুদ্র চষে বেড়িয়েছে এবং তারাই প্রথম শিকারি প্রাণী। তবে ওই স্পঞ্জ এক জায়গায় থাকলেও তারা মূলত কম্ব জেলিরই বংশধর।
নেচার জার্নালে এ গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ হয়েছে। গবেষকরা ক্রোমোজোমের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে জানিয়েছেন, কম্ব জেলি বা টিনোফোরস ছিল অ্যানিমেল ট্রির প্রথম বংশধারা। তাদের কাছ থেকেই বাদবাকি প্রাণীর উৎপত্তি।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আণবিক ও কোষ জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ড্যানিয়েল রোখসার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যারিন শুলৎজ ও ওলেগ সিমাকভের সঙ্গে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সহলেখক।
তিনি বলেছেন, ‘সমস্ত প্রাণীর সাম্প্রতিকতম সাধারণ পূর্বপুরুষ সম্ভবত ৬০ থেকে ৭০ কোটি বছর আগে বেঁচে ছিল। তারা কেমন ছিল তা জানা কঠিন। কারণ, তারা নরম দেহের প্রাণী ছিল এবং সরাসরি জীবাশ্মের রেকর্ড রেখে যায়নি। তবে জিনোম তুলনা করে এই আদি পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে আমরা শিখছি।’
গবেষকরা বলছেন, প্রাণীদের কিছু মূল বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন স্নায়ুতন্ত্র, পেশি এবং পরিপাকতন্ত্র। কৃমি, মাছি, মলাস্ক, সামুদ্রিক তারামাছ, মানুষসহ সবার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো একটি মস্তিষ্ক, একটি মাথা, একটি অন্ত্র ও মুখ থেকে মলদ্বার পর্যন্ত একটি সিস্টেম।
এ ছাড়া জেলিফিশ, সামুদ্রিক অ্যানিমোন, স্পঞ্জ এবং স্টিনোফোরের দেহের গঠন একটু সরল। এদের সুগঠিত কোনো মগজ নেই। আবার স্নায়ুতন্ত্র বা পেশিও নেই। তবে তারাও একটা বিষয়ে অন্যদের সঙ্গে এক। তারও একটি নিষিক্ত ডিম থেকে বহুকোষী দেহের অধিকারী হয়।
এই বৈচিত্র্যময় প্রাণীদের জিন সিকোয়েন্স করেই বিজ্ঞানীরা একটা ফ্যামিলি ট্রি তৈরির চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। এ দৌড়ে স্পঞ্জই এগিয়ে ছিল। কারণ, তারা ছিল এককোষী প্রোটোজোয়ার উন্নত সংস্করণ।
পরে যখন গবেষকরা এই গবেষণায় ক্রোমোজোমে থাকা জিনের বিন্যাসকে বিবেচনায় নিলেন, তখন ধরা পড়ল ভিন্ন চিত্র। রোখসার, সিমাকভ ও অন্য গবেষকরা ধরেই নিয়েছিলেন যে স্পঞ্জ, জেলিফিশ ও এ ধরনের অনেক প্রাণীর ক্রোমোজোমে একই ধরনের জিন আছে।
৫০ কোটি বছরেও যে জিনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এই ক্রোমোজম বেশ ধীরগতিতে বদলায় এবং এর ফলে গবেষকরা সিম্যুলেশন ঘটিয়ে এটা জানার সুযোগ পেয়েছেন যে, কোনো প্রাণীর পূর্বপুরুষের ক্রোমোজমটা কেমন হতে পারে।
টিনোফোরের ক্রোমোজোম গঠন ২০২১ সাল পর্যন্ত অজানাই ছিল। যখন শুলৎজ ও তার সহউপদেষ্টা স্টিভেন হ্যাডক টিনোফোরের ক্রোমোজোম গঠন নির্ধারণ করলেন, তখন এটি দেখা গেল অন্যদের চেয়ে আলাদা।
রোখসার জানালেন, ‘প্রথমে আমরা বলতে পারিনি যে, টিনোফোরের ক্রোমোজোমগুলো অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা কি না। কারণ, তারা অনেক বেশি পরিবর্তিত হয়েছে। আবার এমনও হতে পারে—তাদের কাছ থেকে অন্য প্রাণীর উদ্ভব হওয়ার আগেই তাদের ক্রোমোজম বদলে গিয়েছিল।’
শুলৎজের ব্যাখ্যায় যা গেল তার সারমর্ম হলো, ক্রোমোজোম মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, স্পঞ্জ ও কিছু নন-টিনোফর প্রাণীর ভেতর এমন কিছু পরিবর্তন আছে, যা বিবর্তনের মাধ্যমেই হয়েছে। আবার কম্ব-জেলির ভেতর যে বিন্যাসটা পাওয়া গেছে সেটির সঙ্গে মিল আছে এমন কিছু জীবের, যারা ঠিক প্রাণী নয়।
অর্থাৎ স্পঞ্জের ভেতর ওই পরিবর্তন আসার আগেই কম্ব-জেলির উদ্ভব হয়েছিল। এতেই পরিষ্কার হয় যে খাওয়া, চলাফেরা ও নিজের অস্তিত্ব উপলব্ধি করার মতো প্রথম প্রাণ ওই কম্ব-জেলিই ছিল। আর বিবর্তনের চাবিটাও ছিল তার হাতে।
এসডব্লিউএসএস১৬২৫
আপনার মতামত জানানঃ