মোটামুটি ২ লক্ষ বছর আগে (একদল বিজ্ঞানী বলছেন আধুনিক মানুষের আবির্ভাবের সময় নিয়ে যদিও বিজ্ঞানী মহলে যুক্তি, প্রতিযুক্তি এবং দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব প্রচলিত আছে, তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও আছে) আমরা বিচরণ করছিলাম আফ্রিকার বোতসোয়ানার উত্তর-পূর্বদিকের জাম্বেজি নদীর দক্ষিণতীর ঘেঁষে। মানুষের জীন বিশ্লেষণ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাবাহিক তথ্য ঘেঁটে এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের উপর ভিত্তি করে ডারউইন বিশেষজ্ঞ এমা বিটুয়েল ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবরে ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন ‘প্রাচীন মানুষের আদি জন্মভূমি এবং তাদের বাসস্থান’ বিষয়ক গবেষণাটি।
নেচার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে পিএইচডি গবেষক গারভান ইন্সটিটিউট ফর মেডিকেল রিসার্স এবং সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনতত্ত্বের গবেষক ভানেসা হায়েস বলেছেন, আমাদের ‘আদি মানুষের বাসস্থান’ ছিল আফ্রিকার বোতসোয়ানার মাকগাদিকগাদি লেকের আশেপাশে। যে প্রাচীন জলাধারটি সময়ের পরিক্রমায় এখন শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে। ভানেসা হায়েস নেচার পত্রিকার কাছে বলেন, “আমরা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছি আমাদের প্রাচীন আবাসস্থল। আমরা আবিষ্কার করেছি বর্তমানের মত আধুনিক কংকাল বিশিষ্ট মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে এবং তখন আমরা বর্ণনা করতে শুরু করি মানুষের প্রথম আবির্ভাবের কাহিনী”।
এত সুবিশাল গবেষণা নির্ভর করছে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণের উপর। তখনকার কোষের নিউক্লিয়াসে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ ছিল না। যদিও আমরা জানি যে, নিউক্লিয়াস হলো কোষের শক্তি উৎপাদনকারী যন্ত্র। যুগের পরিক্রমায় এবং বিবর্তনে ডিএনএ’র পরিবর্তন হতে লাগল। প্রতিটি নতুন শিশুর জন্মের মাধ্যমে পূর্বের নিউক্লিয়ার ডিএনএ নতুন ডিএনএ’র সাথে মিলে মিশে পুনর্বিন্যাস হতে লাগল। কিন্তু মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ কখনো বিন্যাসে অংশ নেয় না, তারা থেকে গেল অপরিবর্তিত।
এই গবেষণাপত্রে, গবেষকগণ খুঁজে বেড়িয়েছেন একটা বিশেষ জেনেটিক চিহ্ন – যা মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’র মধ্যে বিদ্যমান। এখানেই লুকিয়ে আছে মানব জাতির শিকড়ের সন্ধান এবং বিজ্ঞানীদের চোখ দিয়ে আমরা দেখতে পারব আধুনিক শারীরিক কাঠামোর প্রথম মানুষ। যাইহোক, বিজ্ঞানীগণ মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’র অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত পরম্পরা খুঁজে পেয়েছেন যার মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছে ঠিক কীভাবে অতীতের মানব প্রজাতি বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর বংশগতিতে ভাগ হয়ে গেছে।
এই গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে, মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ একটা বিশেষ জিনগত বৈশিষ্ট্য বহন করে যে জিনগুলো (L0 mitochondrial DNA) মানুষের জিনের প্রতিনিধিত্ব করে। মানুষের জিনের বংশলতা ধরে প্রথমদিকে চলে গেলে নিঃসন্দেহে বোঝা যাচ্ছে আধুনিক মানুষের শারীরবৃত্তীয় গঠন এবং কংকালের সাথে হুবহু মিলে যায়। গবেষক ভানেসা হায়েস বলেন, এই গবেষণায় ১৯৮ জন সুনির্দিষ্ট নৃগোষ্ঠীর ব্যক্তির জিনগত বৈশিষ্ট্যের পরম্পরা ক্রম পর্যালোচনা প্রমাণ করে আধুনিক মানুষের শরীরে L0 mitochondrial DNA বিদ্যমান। গবেষণায় আরও প্রমাণিত হয়েছে প্রাচীন বাসভূমিতে আদিম মানুষের জীবনযাত্রা কেমন ছিল। কেমন দেখতে সেই প্রথম বাসভূমির চেহারা।
আধুনিক শারীরিক কাঠামোর মানুষ উদ্ভবের কিছু আগে এই এলাকায় বিশাল জলাধার ছিল এবং জায়গাটার নাম ছিল মাকগাদিকগাদি। জলাশয়টির যৌবনে তার আয়তন ছিল ভিক্টোরিয়া লেকের থেকেও বিশাল বড়। এটি আফ্রিকার সবথেকে বড় জলাশয়, যার আয়তন ২৬,৮২৮ বর্গমাইল। মাকগাদিকগাদি জলাশয়টি প্রায় ১০ হাজার বছর আগে শুকিয়ে গেছে, এখন সেখানে পড়ে আছে শুধু বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে লবণাক্ত বিরান ভূমি।
২ লক্ষ বছর পূর্ব থেকেই মাকগাদিকগাদি জলাশয়টি আস্তে আস্তে শুকিয়ে ছোট ছোট ডোবা নালায় পরিণত হতে থাকে। ফলে বিস্তীর্ণ এলাকাতে দেখা দেয় জলমগ্নতা এবং এই স্থানটিই হয়ত প্রথমদিকের মানুষ উদ্ভবের আদর্শ জায়গা। বর্তমানে জায়গাটা দেখতে আর আট-দশটা ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইটের মতই সাদৃশ্যপূর্ণ। বোতসোয়ানাতে ওকাভাঙ্গো বদ্বীপ নামে আরও একটা ইউনেস্কো হেরিটেজ আছে, সেটাও সবসময় জলমগ্ন থাকত। হয়ত সেটাও ছিল মানুষের জন্মস্থানের উপযুক্ত পরিবেশ।
এটা ছিল অবিশ্বাস্য রকমের বিশাল এলাকা এবং সম্ভবত ভীষণ ভেজা আর সবুজ ঘাসে ভরা আকর্ষণীয় একটা জায়গা। সেদিনের পূর্ব-প্রজন্মের প্রথম আধুনিক মানুষের বসবাস এবং বংশবিস্তারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। মানুষের সাথে বন্যপ্রাণীও সেখানে বাস করত প্রচুর। গবেষক হায়েসের মতে, ওকাভাঙ্গো বদ্বীপটিও প্রাকৃতিকভাবে মাকগাদিকগাদির মতই এবং ভৌগলিকভাবে মানুষের প্রথম জন্মস্থানের সাথে ওকাভাঙ্গোর কোন পার্থক্য নেই।
এই ঘাসে ভরা, ভিজে জলাশয় মানুষের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ভানেসা হায়েস বলেন, জলবায়ুর বিশেষ কিছু পরিবর্তনের কারণে মানুষের সুখের বাসস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানে মানুষ প্রজাতির উন্নতি প্রায় ৭০,০০০ বছর অব্দি স্থায়ী হয়েছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭১০
আপনার মতামত জানানঃ